২৫ অক্টোবর ২০২৫

মোটরসাইকেল চুরি হয় যেভাবে

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের খেইল। চোখের পলকে মাস্টার চাবির ব্যবহার। কল্পনাও করা যায় না চক্রের কৌশল। অভিনব কায়দায় না পারলে মোটরসাইকেলের ঘাড় মটকে লক ভেঙ্গে চম্পট।

চুরির বিষয় টের পেয়ে মোটরসাইকেল মালিকের চিৎকারে চক্রের সদস্যরা হৈ হাই করতে করতে দ্রুত পলায়ন করে বিদ্যুতের গতিতে। সম্পূর্ণ প্রশিক্ষিত চোর সিন্ডিকেট। গ্রেফতারের পর চোর চক্রের সদস্যরা পুলিশের লাঠিপেটার ভয়ে তোতা পাখির মত বলে দেয় চুরির কৌশল।

মোটরসাইকেল চুরি, বিভিন্ন পরিবর্তন, স্টকে রাখা ও বিক্রির ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন জন জড়িত থাকে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয় আবার জামিনে বেরিয়ে একই কাজে নেমে যায়। জেলখানায় পরিচয়ের সুবাদে চোর চক্র একটি নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা করে।

চুরি করা হাজার হাজার মোটরসাইকেল তাদের ইশারায় চলে যাচ্ছে শত শত মাইল দূরে। পাচার ও বিক্রি হচ্ছে গ্রামে গঞ্জে। তবে উদ্ধার হওয়া মোটরসাইকেল মালিকানা নিশ্চিত করে ফেরত দেওয়া হয়।

কৌশলী চোরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমেই ফেলে দেয়া হয় নম্বরপ্লেট। এরপর যন্ত্রাংশেরও পরিবর্তন হয় কিছু কিছু। আউট লুকিং ভাল করতে রংয়েরও পরিবর্তন হয় কিছুক্ষেত্রে। চেচিস নম্বরও টেম্পারিং করা হয় প্রয়োজনে। গ্রামেগঞ্জে বিক্রি হচ্ছে হাতের মুঠোয় থাকা ৪০/৫০ হাজার টাকায় বাই সাইকেলের দামে।

অবাক হওয়ার কিছু নেই যারা বিক্রি করছে তারা ক্রেতারাই স্বজন। কারণ চোর চক্র গ্রামের স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে টানা মোটর সাইকেলের ঘোষণা দেয়। এরপরই শুরু হয় টার্গেট অনুযায়ী বিক্রি। শহরে বা মেট্রোপলিটন এলাকায় বিক্রি না করার অন্যতম কারণ ট্রাফিক ও থানা পুলিশের চেকপোস্টের ভয়ে।

দীর্ঘ দিন মিল্টন সরকার এবং রফিকুল ইসলাম রিপন চুরির কৌশল ঠিক করে। চট্টগ্রাম মহানগর সহ দেশের বিভিন্ন জেলা হতে লক করা মোটরসাইকেল বিশেষ কায়দায় তৈরী করা মাষ্টার চাবি দিয়ে দ্রুততম সময়ে চুরি করে নিয়ে যায়। চোরাই মোটরসাইকেলগুলো হতে মিল্টন সরকার কিছু মোটরসাইকেল কদমতলী বুলুর গ্যারেজে মেহেদী হাসান এর মাধ্যমে বিক্রয়ের জন্য জমা রাখে।

আনোয়ারুল ইসলাম চোরাই মোটরসাইকেল মিল্টন সরকার এবং রফিকুল ইসলাম রিপন থেকে ক্রয় করে মোঃ ওবায়দুল কাদের এর গ্যারেজে রাখে। চক্রের বিভিন্ন সদস্য ঘুরে ফিরে চুরি করে। কেউ জেলে থাকলে অন্যরা অর্থের যোগান দিয়ে জামিনে বের করে আনে। চক্রের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী একটিভ ওবায়দুল কাদেরসহ শাখাওয়াত হোসেন রুবেল, মাহমুদুল হাসান, শাহাদাত হোসেন সাজ্জাদ, রাশেদুল ইসলাম মজুমদার, শাহিন উদ্দিন, মনির প্রকাশ বড় মনির, মনির প্রকাশ পিচ্ছি মনির তারা চোরাই মোটরসাইকেল ক্রয়-বিক্রয় করে।

সম্প্রতি বেশকয়েকটি চোরাই মোটর সাইকেল উদ্ধারের ঘটনা থেকে জানা গেছে মোটর সাইকেল চুরির নানা কৌশল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চোর চক্রের অন্যতম হোতা মেহেদী হাসান জানায় যে, কাগজপত্র বিহীন আরো একটি হাঙ্ক মোটরসাইকেল কদমতলী মোড়স্থ সিয়াম বাইক সার্ভিসের সামনে রাস্তার উপর আছে। রাত দেড়টার দিকে জব্দ করেন লাল রংয়ের ১৫০ সিসির হাঙ্ক মোটরসাইকেল (নং-কক্সবাজার-ল-১১-২৩৪১)। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ দুজনকে আটক করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সরকার পুলিশকে জানিয়েছে, কাগজপত্র বিহীন আরেকটি হাঙ্ক মোটরসাইকেল সীতাকুন্ডের আনোয়ার এর নিকট, ৭টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বড় দারোগা হাটের ওবায়দুল কাদেরের নিকট, ২টি ডিসকভার মোটরসাইকেল নাঙ্গলকোর্ট এলাকার মাহমুদুল হাসানের নিকট, একটি এফজেড মোটরসাইকেল রামগড় এলাকার রুবেল হোসেন এর নিকট রয়েছে।

চোর চক্রের সদস্য মিল্টনের তথ্যের ভিত্তিতে সীতাকুন্ড থানাধীন বড় দারোগারহাট বাজার টার্ন রোড এর পশ্চিম দিক ওবায়দুল কাদেরের গ্যারেজে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে আনোয়ারুল ইসলাম থেকে একটি গ্লেমার মোটরসাইকেল, ওবায়দুল কাদের থেকে তিনটি গ্লেমার, দুটি ডিসকভার, একটি ইয়ামাহা, একটি পালসারসহ মোট আটটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করতে গিয়ে ঘড়ির কাটায় সকাল পৌনে ৬টা। আটক করা হয় আনোয়ারুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদেরকে।

অপরদিকে, এসআই সুকান্ত চৌধুরীর টিম ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় অভিযান চালায়। হেঁয়াকো পশ্চিম বাজার ট্রাক সমিতি অফিস সংলগ্ন কাদেরী অটো মোবাইলস নামক সিএনজি মোটর পার্টস দোকানের সামনে রাস্তার উপর থেকে শাখাওয়াত হোসেন প্রকাশ রুবেলের কাছ থেকে একটি লাল কালো রংয়ের ইয়ামাহা এফজেড উদ্ধার করেন। তবে এই মোটরসাইকেলটির ইঞ্জিন নম্বর ও চেসিস নম্বর ঘষামাজা ছিল। নম্বরপ্লেটে (চট্টমেট্রো-ল-১৪-৬২৬৬) লেখা আছে। তখন গ্রেফতার করা হয় রুবেলকে।

এদিকে, এসআই মোঃ মনজুরুল আলম কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোর্ট থানাধীন শরীফপুর গ্রামস্থ বায়তুস সুজুদ জামে মসজিদ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে মাহমুদুল হাসান থেকে একটি কালো রংয়ের ডিসকভার মোটরসাইকেল উদ্ধার করে। তবে এটি অনটেস্ট লিখে চালানো হচ্ছিল। অটককৃতরা মোটরসাইকেলের ডকুমেন্ট দিতে না পারায় শুরু হয় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সীতাকুন্ডের মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক ওবায়দুল কাদের জানায়, তার কাছে মোটরসাইকেলগুলো বিক্রয় করার জন্য আনোয়ার দিয়েছে। আনোয়ার জানায় মিল্টন সরকার এবং রফিকুল বিভিন্ন স্থান হইতে চোরাই গাড়ি সংগ্রহ করে তার নিকট বিক্রয় করে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে এসআই মনজুরুল আলম এরপর রফিকুল ইসলাম রিপনকে আগ্রাবাদ মিস্ত্রি পাড়ার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। তবে সিডিএমএস সফটওয়্যার যাচাই করে পুলিশ দেখেছে, মিল্টন সরকার এবং রফিকুল ইসলাম রিপন এর আগেও মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় একাধিকবার জেলে ছিল। জামিনে বেরিয়ে আবারও আগের পেশায়।

মিল্টন সরকার ও মেহেদী হাসান জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, কদমতলী এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া মোটরসাইকেলটি মিল্টন সরকার নিউমার্কেট হইতে চুরি করেছিল।

এ ঘটনায় রাশেদুল ইসলাম মজুমদার, শাহিন উদ্দিন, মনির প্রকাশ বড় মনির, মনির প্রকাশ পিচ্ছি মনির মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় পলাতক রয়েছে। মূলত আসামী রফিক ও মিল্টন একে অপরের সহিত জেলখানায় পরিচয় হয়। জেলখানায় পরিচয়ের সুবাদে তারা একটি নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা করে। সে মোতাবেক তারা চুরি করে চোরাইকৃত মোটরসাইকেল আনোয়ার এর কাছে বিক্রয় করে। আনোয়ারা উক্ত মোটরসাইকেল ওবায়দুল কাদের এর গ্যারেজে রেখে ওবায়দুল কাদের সহ শাখাওয়াত হোসেন রুবেল, মনির প্রকাশ বড় মনির, পিচ্ছি মনির, শাহিন উদ্দিন, রাশেদুল ইসলাম মজুমদার দের নিকট বিক্রয়ে করে বলে স্বীকার করে।

মোটরসাইকেল চুরির বিষয়টি জানতে প্রশ্ন করা হলে, কোতয়ালী থানার এসআই মো. মনজুরুল আলম বাংলাধারাকে বলেন সম্প্রতি স্পটসার্চ চেকপোস্ট পরিচালনা করে নগরীর আটমার্সিং সড়কে। রাত সোয়া ১২ টার দিকে দুইজন লোককে নাম্বার প্লেট বিহীন একটি হাঙ্ক মোটরসাইকেলসহ গতিরোধ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সরকার ও মেহেদী হাসান মালিকানা কাগজ দেখাতে পারেনি। এমনকি কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। মিল্টন সরকার এবং রফিকুল ইসলাম রিপন চুরির কৌশল জানিয়েছে।

বাংলাধারা/এফএস/এআই

আরও পড়ুন