৪ নভেম্বর ২০২৫

মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছাড়া আমাদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ

আকাশ ইকবাল »

(১)
মাস্টারদার সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম আমরা চিনি। তাঁরা কেন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন সেটাও আমরা জানি। এটাও জানি তাঁরা শুধু মাত্র ইতিহাসের অংশ নয়, ব্যক্তি হিশেবেও একেক জন ইতিহাস। কারণ, এই ইতিহাস থেকে তাঁদের কেউ একজনকে বাদ দিলেই পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

(২)
মাস্টারদার সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামকে নিয়ে আমরা চর্চা করি। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময়ে। আবার বিভিন্ন কারণে এরকম অনেক ইতিহাস আমরা চর্চা করি না, অর্থাৎ জানি না কিংবা শুনিনি। অনেক সময় জানার পরও চর্চা করি না। কিন্তু করা উচিত। ইতিহাসে কাউকে কোনো কারণে ভেদাভেদ করা যায়। সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য যে কর্মই করে যাক, সেই কর্মের জন্য তাঁকে আমাদের চর্চা করা উচিত। সঠিকভাবে ইতিহাস চর্চাই আমাদের সভ্য ও শিক্ষিত করে তুলে সত্যের পথে নিয়ে যাবে।

(৩)
আমাদের ইতিহাস চর্চার করুণ অবস্থা সেই অতিতেও ছিল, এখনও চলছে। আমাদের ইতিহাস চর্চার অনেক সমৃদ্ধ উপকরণ থাকলেও তার সংরক্ষণ ও যথার্থ উপস্থাপন নেই। কথাটা এই জন্যই বলছি, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস থেকে যদি মাস্টারদাকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে ইতিহাসটা অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ঠিক একইভাবে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকেও বাদ দিলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ। কারণ তিনিও এই ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি নিজেও একটি ইতিহাস। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে এই মানুষটা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং অংশগ্রহণ করেছেন।

(৪)
মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নামের পাশে আমি কেন বহুমাত্রিক কিংবদন্তী শব্দ দুটি যোগ করলাম? কারণ, তিনি শুধু মাত্র বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে থেমে থাকেননি, তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক ও সংগঠক।

(৫)
বৃটিশ সরকারের অনেক বাধা-বিপত্তি ও জেল-জুলুমকে উপেক্ষা করে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর দৃঢ়তার সাথে সাংবাদিকতা করেছেন। বৃটিশ সরকারের অন্যায়, অবিচার, জুলুমের কথা সরাসরি তার সম্পাদিত পত্রিকা দৈনিক ছোলতানে প্রকাশ করেছেন।

আমরা জানি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। মূলত স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশের মানুষ অধিকার বঞ্চিত, অত্যাচারিত হওয়া থেকেই জন্ম নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ভাবনা। একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম একার পক্ষে সম্ভব নয়, প্রয়োজন অনেক মানুষ এবং শক্ত সংগঠনের। এরপর স্বাভাবিক ভাবেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হোন, তাও কংগ্রেসের সাথে। ১৯০৭ সালে মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য হোন।

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েও তিনি কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুসলিম লীগের লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। কারণ, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আন্দোলন না করা এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থাকার জন্য মুসলমান সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ চাচ্ছিল মুসলমান সমাজ নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের। কিন্তু মনিুরজ্জামান ইসলামাবাদী তা চাননি। মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মুসলিম লীগের সুবিধাবাদী নীতি ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিবরণ মানষের কাছে তুলে ধরেন।

তিনি ইসলামী পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী হলেও ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পূর্ব থেকেই উর্দু নয়, বাংলা ভাষার প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বাংলা ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য সে সময় তিনি জোর প্রয়াস চালিয়েছেন। বাংলার পাশাপাশি উর্দুতে সমান পারদর্শি হলেও তিনি কখনও উর্দুতে বক্তব্য দেননি। এমনকি প্রাদেশিক সংসদে তিনিই প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন এবং কার্যবিবরণীতে তার বক্তব্য বাংলায় লিখতেন।

তিনি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন না। কারণ, তখনকার সময় মাদ্রাসাগুলোতে মাতৃভাষা বাংলা কিংবা ইংরেজি ভাষায় কিছু পড়ানো হতো না। শুধু মাত্র ধর্মীয় ও আরবি-ফারসি ভাষায় শিক্ষা প্রদান করা হতো। তিনি মনে করতেন শুধু মাত্র ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে একজন ছাত্রের সঠিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব না। তিনি চেষ্টা করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার। এজন্য তিনি মাতৃভাষা বাংলা এবং ইংরেজিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত করতে। একই সাথে পাঠসূচীতে যোগ করতে চাইলেন বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাস।

তাঁর ছিল সাহিত্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। খাঁটি সাহিত্য রচনা না করলেও তিনি বেশ কিছূ বই লিখেছিলেন। সাহিত্য রচনায় অতটা অবদান না রাখলেও সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেচছন।

সমাজ সংস্কার বলতে তিনি শুধু কুপ্রথা উচ্ছেদ নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজকে গতিময় ও যুগোপযোগী করাই প্রকৃত সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করতেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত শ্রেণীবৈষম্যের কঠোর সমালোচনা ও বিরোধীতা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজ সংস্কারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সাংগঠনিকভাবে তার প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে ওলেমার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, ঘুষ, দুর্নীতি ও সুদের ব্যবসা সমাজ থেকে দূর করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজও করেছিলেন।

তিনি আজীবন নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য স্কুল, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। মানবতার জন্য দান করে গেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। শেষ জীবনে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে যুক্ত হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের সেকেন্ড ইন কমান্ড এর দায়িত্ব পালন করেন।

তার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। সেই লক্ষ্যে সরকার ও তৎকালীন আনোয়ার জমিদারের কাছ থেকে ৬০০ বিঘা জমির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যলয়ের ভিত্তিপ্রস্থরও স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে যুক্ত হওয়া ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রীয় কর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য এবং শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।

মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে মৌলানার কোনো যোগাযোগ কিংবা সম্পর্ক ছিল কিনা সেরকম তথ্য আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে আমার বিশ্লেষণ বলছে, হয়তো বা যোগাযোগ কিংবা সম্পর্ক থাকতে পারে। এই বিষয়েও আমি একটা প্রবন্ধ লিখেছি এই বইতে।

(৬)
আমি আশা করছি, বহুমাত্রিক কিংবদন্তি মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী পড়ে উপরের আলোচিত বিষয়গুলোর তথ্যসূত্র সহ বিশ্লেষণ পাবেন। বইটি আমি ছোটদের উদ্দেশ্য করে লিখেছি। আমি মনে করি, এটি বড়রাও সংগ্রহে রাখতে পারবেন।

(৭)
বইটি প্রকাশ করেছে তৃতীয় চোখ প্রকাশনা। পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বইমেলায় তৃতীয় চোখের স্টলে। এটির প্রচ্ছদ করেছেন সুহৃদ রহমান আর ভূমিকা লিখেছেন প্রকাশক আলী প্রয়াস নিজেই। মূল্য: ১৮০ টাকা।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ