জালালউদ্দিন সাগর »
বাবা সারাদিন রাজনীতি নিয়ে থাকতেন। থাকতেন মানুষকে নিয়ে। যখনই বাবার সাথে দেখা হতো তখনই দেখতাম বাবার চারপাশে শুধুই মানুষ। কখনো বৈঠকখানায়, কখনো বাড়ির আঙিনায়। বাবার ধ্যান-ধ্যারণায় শুধুই চট্টগ্রাম।
বাবার কাছে যাওয়ার সুযোগ কম ছিল বলেই হয়তো বাবার সাথে তেমন করে কোনো সখ্যতা গড়ে ওঠেনি আমার! আমার সবটুকু জুড়ে শুধুই ‘মা’- কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা-কালজয়ী পুরুষ চট্টলার বীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন।
গত বছর নভেম্বরে বিশেষ একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম চৌধুরী ভবনে। সেখানেই কথা হয়েছিল সালেহীনের সাথে।
আলাপচারিতার পুরোটা সময়জুড়ে সালেহীন নিজের কথা বলতে গিয়ে কেবলই বারবার ফিরে আসছিলেন মায়ের কথাতেই। মায়ের কাছেই।
বললেন, মায়ের সবটুকু জুড়েই আমরা ভাইবোনেরা। আমাদের সব ভাইবোনকে মা বাবার চেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন। দেখাশুনা করেছেন।
আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, প্রিয়-অপ্রিয় সব ব্যাপারগুলোই মায়ের নখোদর্পনে ছিল। আমার বোনের পছন্দের রঙের খবর মা যেমন জানতেন ঠিক তেমনি আমরা কোন ভাইয়ের কোন কালারের শার্ট পছন্দ তাও। যোগ করলেন সালেহীন।
আলাপচারিতায় আরও বললেন, এইতো আমাদের শৈশবের কথা। যখন মা অনেকটাই ঘরমুখো ছিলেন। ফ্রি ছিলেন। কিন্তু এখন মা অনেক ব্যস্ত। বাবার মতোই মা এখন মানুষ নিয়ে ভাবেন। অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে বাবার মতো নগরীর এ গলি ও গলি ছুটে বেড়ান।
বছর তিনেক আগের কথা বলি। বললেন সালেহীন। হঠাৎ করে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় আমার। দেখি মা বসে আছে আমার বিছানার মাথার ঠিক পাশে। এতো রাতে মাকে দেখে ঘুমঘুম চোখে তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলে মা হাত চেপে ধরেন। বলেন, তোর জ্বরটা অনেক বেড়েছে। শুয়ে থাক।
মায়ের হাত ধরেই কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। আমার মাথায় হাত দিয়ে মা জেগেছিলেন। অনেকক্ষণ জেগেছিলেন। ফজরের নামাজ পড়ে তারপর মা নিজের রুমে যান। যোগ করেন সালেহীন।
সন্তানের প্রতি সব মায়েরই দরদ-মমতা প্রাকৃতিক। ঈশ্বর প্রদত্ত। তবুও কেন জানি মনে হয় ঈশ্বরের দেয়া স্নেহ-মমতা একটু বেশি আমার মায়ের কাছে। মৃদু হেসে বলেন সালেহীন।
সালেহীন আরও যোগ করেন বলেন, রাজনীতির কারনে বাবাকে অনেক সময় জেলে থাকতে হয়েছে। পালিয়ে থাকতে হয়েছে। সে অসময়গুলোতে শত কষ্ট হাসি মুখে সহ্য করে আমাদের সব ভাইবোনকে বড় করে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সালেহীন বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মা কখনো মুসরে পড়েন নি। সব সময় বাবাকে সাহস যুগিয়েছেন। আমাদের অভয় দিয়েছেন। সব পরিস্থিতিতে মায়ের মুখে লেগে থাকা মৃদু এই হাসি আমাদের সব ভাইবোনকে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সাহস যুগিয়েছে সব সময়।
গত বছর শেষভাগে সালেহীনের বায়োগ্রাফিকাল ইন্টারভিউ নিতে গেলে ঠিক এভাবেই মায়ের গল্প বলেছিলেন সালেহীন। প্রকাশিত সে ইন্টারভিউতে তেমন ভাবে মায়ের এ গল্প বলার সুযোগ হয়নি।
গত ১০ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন সালেহীন। তার একদিন পর সেই মহামারি বাসা বাঁধে সালেহীনের মা হাসিনা মহিউদ্দিনের শরীরেও। যে ভাইরাসে সন্তান আক্রান্ত হয়েছেন সে ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন মাও। এ যেন সে নাড়ির ঐশ্যরিক বন্ধন।
যখনই ফেসবুকে সালেহীন আর তার মায়ের এই নির্মল হাস্যোজ্জল ছবিটি দেখি তখনই সালেহীনের বলা কথাগুলো মস্তিস্কে অনুরণ সৃষ্টি করে। যে অনুরণ অনন্তকাল আজ দুঃসময়ে পাশে সাথে থাকার গল্প বলে।
লেখক : সাংবাদিক













