বাংলাধারা ডেস্ক »
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম প্রধান উপকরণ রডের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতি টন রড ১ লাখ ১ হাজার থেকে ১ লাখ ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত দুই দিনে রডের বাজারের শীর্ষ সারির কোম্পানিগুলো প্রতি টন রডের দাম ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা বাড়িয়েছে। এর প্রায় প্রতিদিনই রডের দাম বেড়েছে। এর আগে দেশে কখনোই লাখ টাকায় রড বিক্রি হয়নি বলে উৎপাদকরা জানিয়েছেন।
দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প, আবাসন খাত ও গ্রামাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে রডের চাহিদাও বেড়েছে বেশ। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছুতেই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি তেলের দাম এবং চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আর এতে বাড়তে থাকে মাইল্ড স্টিল (এমএস) রডের দাম, যা এবার ইতিহাস গড়ে দেশের বাজারে লাখ টাকা টন ছাড়াল।
রড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রডের দাম বেড়েছে আরও সপ্তাহখানেক আগেই। টনপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। রডের দাম বেশ কিছুদিন ধরেই অল্প অল্প করে বাড়ছিল।
রাজধানী বাড্ডার মেসার্স পাটোয়ারী স্টিল করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী বাবুল পাটোয়ারী গতকাল বিকেলে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বিএসআরএম রডের টন ১ লাখ ২ হাজার আর কেএসআরএম রডের টনের দাম ১ লাখ ১ হাজার টাকা। রডের দাম বাড়ার খবর তো নতুন না। কয়েক দিন ধরেই দাম বাড়ছিল।’
দাম বাড়ায় কি আগের চেয়ে বিক্রি কমেছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা তো কমেছেই। কারণ মানুষেরও তো একটা ক্রয়ক্ষমতা আছে। ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে তো মানুষের যেকোনো কিছুই কিনতে সমস্যা হবে। অনেকেই অপেক্ষা করছেন দাম কমলে হয়তো তারা কিনবেন।’
আনিস ট্রেডার্সের আরেকজন রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান বলেন, ‘রড সিমেন্টসহ অবকাঠামো নির্মাণের সব সামগ্রীর দামই বাড়তির দিকে। এতে আমাদের বেচাবিক্রি কমেছে। দাম বাড়লে আমাদের আসলে লোকসান।’
রড কিনতে আসা মুহিব নামে একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি গত মাসে রড কিনতে বাজারে এসেছিলাম। দাম একটু বাড়তির দিকে থাকায় অল্প পরিমাণে কিনেছিলাম তখন। দাম সামনে আরেকটু কমবে এই ভাবনা ছিল। কিন্তু আজকে বাজারে এসে দেখি রডের টনপ্রতি আগের দামের চেয়ে আরও ৭-৮ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। আমার যে পরিমাণ রড লাগবে, তাতে তো বাড়ি তৈরিতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। যা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক টাকা বেশি চলে যাবে আমার বাড়ি করার পেছনে।’
মোহাম্মদপুরের বছিলার ইতালিপ্রবাসী রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রবাস থেকে ফিরে একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করে বিক্রি করার চিন্তা করি। সে অনুযায়ী ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপনও লাগাই। তাহসানুল করিম তুষার নামে একজন ক্রেতা আমার বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহ প্রকাশ করে ফ্ল্যাট বুকিংয়ের জন্য কথা বলেন। আমি তার কাছে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে ২৭ লাখ টাকার জন্য চুক্তি করলে তিনি অগ্রিম ১৫ লাখ টাকার চেক দেন। তারপর বাজারে গিয়ে রডের দাম শুনে আমার বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় বাজার সম্পর্কে ধারণা ছিল না। হিসাব করে দেখি ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে দাম দাঁড়ায় ৪৫ লাখ টাকার ওপর। অগ্রিম টাকা নিয়ে চুক্তি করার ফলে তা থেকে সরে আসতে পারিনি। তবে পরবর্তী সবগুলো ফ্ল্যাট ৪৫ থেকে ৪৬ লাখ টাকায় বিক্রির চুক্তি করি।’
দাম আরও বাড়বে
রড তৈরির অন্যতম উপকরণ বা কাঁচামাল স্ক্র্যাপ। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম বেশি বলে রডের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট। এই বিলেট উত্তপ্ত করে ছাঁচে ফেলে রড তৈরি করা হয়।
শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া ডলারসংকট দাম বাড়ার একটি বড় কারণ। ডলারসংকটের কারণে ক্রমাগত বাড়ছে আমদানি ব্যয়। সেই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে। পাশাপাশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডেও তৈরি হয়েছে জাহাজের সংকট। মিলগেটে প্রতি টন রড বিক্রি করা হচ্ছে ৯৭ হাজার টাকায়। মিলগেটের মূল্যের সঙ্গে পরিবহন, লোডিং এবং আনলোডিংয়ের মতো অন্যান্য খরচ যোগ করা হলে ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা মূল্য প্রতি টন ১ লাখ টাকার বেশি পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এলসি করতে না পারায় পর্যাপ্ত জাহাজ আনা সম্ভব হয়নি। এতে করে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রড তৈরির কাঁচামালের দামও বেড়েছে অনেক। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয়েও প্রভাব পড়েছে। দাম বাড়ার প্রভাবে বিক্রি কমে গেছে। এতে করে ব্যবসার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলাও কঠিন হয়ে পড়েছে ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীদের। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রডের দাম কমার তেমন সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে রডের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
টিসিবির তথ্যে ফারাক
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য আর স্টিল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যে ব্যাপক গরমিল দেখা গেছে। টিসিবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম গত মঙ্গলবার ৮৫ হাজার টাকা মেট্রিক টন উল্লেখ করা হয়। আর ৪০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ৮২ হাজার টাকা মেট্রিক টন উল্লেখ করা হয়।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, আগের সপ্তাহে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ছিল ৮৭ হাজার টাকা। আর ৪০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ছিল ৮৩ হাজার টাকা, যা কমে এ সপ্তাহে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ও ৮২ হাজার টাকা টনে।
বিএসআরএমের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএসআরএম মিলগেটে প্রতি টন রড বিক্রি করছে ৯৮ হাজার ৫০০ টাকায়, যা ঢাকা বা অন্যান্য স্থানে যাওয়ার পর প্রতি টন ১ লাখ ২ বা ৩ হাজার টাকায় দাঁড়াবে।
বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৫ শতাংশ
এক বছরের ব্যবধানে মিলগেটে ভালো মানের বা ৬০ গ্রেডের এক টন রডের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে কোম্পানিভেদে প্রতি টন রড খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয়েছিল ৭১ থেকে ৭৮ হাজার টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ টাকার বেশি দামে।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম ছিল প্রতি টন ৬৬ হাজার থেকে ৬৮ হাজার টাকা। আর ৪০ গ্রেডের রডের দাম ছিল ৬৪ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।













