আলমগীর মানিক, রাঙামাটি »
পাহাড়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের ঘোষণার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওই অঞ্চলের উপজাতীয় সশস্ত্র চাঁদাবাজরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাঙামাটি হতে চলে যাওয়ার পরদিন থেকেই পাহাড়ে চলমান উন্নয়ন কাজের ওপর চাঁদাবাজির চাপবৃদ্ধিসহ প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। অব্যাহত চাঁদার চাপে রাঙামাটিতে চলমান শতকোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন থমকে গেছে বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যেই আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে কোটি টাকা চাঁদার দাবিতে সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কয়েক দফা হামলার ঘটনায় সাইট থেকে পালিয়ে অন্য স্থানে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন অন্তত ২৫ জন শ্রমিক। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বন্দুকের বাটের আঘাতে আহত হয়েছেন এক মাঝি। কয়েক দফা হামলা চালিয়ে কর্মরত দিনমজুরদের কাছ থেকে অন্তত ৮টি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। পহেলা জুন এই ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে রাঙামাটির সদর সার্কেলের এডিশনাল এসপি জাহেদুল ইসলাম, কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ কবির হোসেনসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রতিবেদককে বিষয়টি নিশ্চিত করে উক্ত ঘটনার সাথে কারা জড়িত সেটি পুলিশ খতিয়ে দেখছে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এডিশনাল এসপি।
এদিকে, স্থানীয় আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র এই সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদা দাবির প্রেক্ষিতে সৃষ্ট অচলাবস্থায় নিজেদের পূঁজিপাট্টা উঠাতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , এলজিইডি’র মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটির আসামবস্তি হয়ে কাপ্তাই সড়কটিতে তিনটি প্যাকেজের আওতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার প্রকল্প কাজ বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি রাঙামাটি সদর অফিস কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের ঘনিষ্টজনেরা জানিয়েছেন, বিগত ২০২০ সালের জুন মাসের ৯ তারিখ থেকে সড়ক মেরামতের কাজ করছে দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ শুরুর আগেই পাহাড়ে চলমান রীতিনুসারে কাজের জন্য নির্ধারিত হারের চাঁদার টাকা স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোকে প্রদান করা হয়েছিলো। চলতি বছরের জুন মাসের ৩০ তারিখে উক্ত কাজ শেষ হওয়ার কথা। হঠাৎ করেই গত ৩০ মে থেকে কাজ বন্ধ করার জন্য ফোনে হুমকি প্রদান করে আসছিলো জেএসএস এর পরিচয়দানকারি জনৈক কালেক্টর অপু চাকমা। বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় পরপর দুইদিন একদল সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী মানিকছড়ি নামক এলাকায় এসে শ্রমিকদের শাসিয়ে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে যায়। পরেরদিন বুধবার এলাকার কিছুদূর অদূরে শ্রমিকরা আবারো কাজ করতে গেলে সেখানে অতর্কিত হামলা চালিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে একজন ‘মাঝি’কে বেধড়ক পিটিয়ে করে তার মোবাইলটিও নিয়ে যায় এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছুঁড়ে। এ সময় সন্ত্রাসীরা এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই ঘটনার পরপরইকাজ ফেলে রেখে শ্রমিকরা প্রাণভয়ে অন্য স্থানে সরে গেছে বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাঙামাটি এলজিইডি’র সদর উপজেলা প্রকৌশলী প্রণব রায় চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করলেও কে বা কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত সেটি তিনি অবগত নন বলে জানান। তিনি বলেন, আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী আহম্মদ শফি বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখছে বলে আমি খবর নিয়ে জেনেছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ-আর্মি গেছেন তারাই ঘটনাটি দেখছে বলেও জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ঠিকাদার জানিয়েছেন, আসামবস্তি সড়কের বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্টরা শহরের রাঙ্গাপানিস্থজেএসএস এর নেতার সাথে সাক্ষাতে গেলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কাজ যখন বন্ধই করেছি সেক্ষেত্রে আর কোনো চাঁদা লাগবে না। এই রাস্তা করতে দেওয়া হবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ২৬ মে রাঙামাটিতে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণাসহ সেদিনের অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ যেসব বক্তব্য স্থানীয় চাঁদাবাজদের লক্ষ্য করে দিয়েছিলেন সেই বক্তব্যের কারণেই রাঙামাটিতে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে লক্ষ্য করে মোটা অংকের চাঁদার দাবি নিয়ে মাঠে নামছে রাঙামাটিতে আধিপত্য বিস্তারকারি প্রভাবশালী আঞ্চলিকদল। ইতিমধ্যেই আসামবস্তি এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারি ঠিকাদার কাছে জেএসএস এর পরিচয় দিয়ে অপু চাকমা ০১৬৭৩১৯৯৩৮৩ এই নাম্বার দিয়ে ফোন করে কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটিতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাধ্যমে সড়ক উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নকারি একটি বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও ফোনের মাধ্যমে চাঁদা দাবি করেছে জেএসএস নামধারী সন্ত্রাসীরা। নির্ধারিত হারের চাঁদা না পাওয়ায় কয়েকদিন আগে রাঙামাটির মুখ মানিকছড়ির দেপ্পোছড়ি এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই’র এর একটি রোটারি পাইলিং মেশিনে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল মমতাজ নামের একজন প্রকৌশলী প্রতিবেদকের বিষয়টি স্বীকার করলেও কে বা কারা এই কাজের সাথে জড়িত সেটি জানেন না বলে জানান।
এদিকে চলতি সপ্তাহে রাঙামাটির রাইখালীতে জেএসএস’র টোকেন না কেটে বালু আনতে গেলে রহমান কোম্পানীর একটি বালুবাহি গাড়ি আটকিয়ে চাবি নিয়ে গেছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়াও রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারের এক ব্যবসায়ীর কোমলপানীয় ভর্তি একটি গাড়ি আটকিয়ে চাবি নিয়ে যায় জেএসএস নামীয় একদল পাহাড়ি চাঁদাবাজ। পরবর্তীতে অপর একটি নকল চাবি দিয়ে গোপনে গাড়িটি নিজেদের কাছে নিয়ে আসে ব্যবসায়ীর লোকজন। এনিয়ে চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ব্যবসায়ীকে হুমকিও দিয়েছে বলে ব্যবসায়ীর এক স্বজন জানিয়েছেন। এদিকে রাঙামাটি বড়ইছড়ি সড়কে চলমান একটি ব্রিজের কাজও চাঁদার দাবিতে বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাঙামাটির একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন, মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জিওসি’র বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেই নিজেদের সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি করছে অত্রাঞ্চলের আঞ্চলিকদলগুলো। ইতিমধ্যেই রাঙামাটিতে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোতে নিজেদের জন্য ১০ শতাংশ চাঁদার দাবি করে ফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে স্থানীয় আঞ্চলিকদলগুলো। ঠিকাদাররা জানিয়েছেন, আগে সব মিলিয়ে ৫ শতাংশ হারে চাঁদা দিতে হতো। কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে পুনরায় ফোন করে জেএসএস এর পক্ষ থেকে দ্বিগুনহারে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার পরেও বর্তমানে রডের মূল্যবৃদ্ধিতে ঠিকাদারদের দিশেহারা অবস্থা,
বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেছেন, পাহাড়ের উন্নয়নের জন্যেই শান্তিচুক্তি করা হয়েছিলো। চুক্তির আলোকে পাহাড়ে এই সমস্ত চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন গুমের মতো ঘটনাগুলো মোটেও থাকার কথা নয়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর একটি বছর ভালোভাবে চলার পর পুনরায় আবারো জেএসএস নিজেদের সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ে মূলত চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই তথাকথিত আঞ্চলিকদলের নামে সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। এদের প্রধান কাজই হলো চাঁদাবাজি। পাহাড়ের চলমান এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান লক্ষ্য হলো সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া। জনগণকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।













