৩০ অক্টোবর ২০২৫

রাঙ্গুনিয়ায় গৃহবধূর মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল— পরিবারের দাবি হত্যা

আশিক এলাহী, রাঙ্গুনিয়া »

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম নবাবী পাড়া এলাকার ফারহানা আকতার বকুল (২৬) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু নিয়ে এলাকায় ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। গত বুধবার (২৩ মার্চ) সকালে শ্বশুর বাড়িতে মারা যান তিনি। গৃহবধূর শ্বশুরপক্ষ প্রথমে আত্মহত্যা বলে প্রচার করলেও রোববার (২৭ মার্চ) বিকেলে আত্মহত্যা কিংবা হত্যাকাণ্ড কোনটিই বলতে রাজি নন।

এদিকে মৃত বকুলের বাবা আবুল বশর এটিকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার চালিয়ে আসছে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ নিয়ে বৈঠক করেও তার সংসারে সুখ এনে দিতে পারলাম না। আমার মেয়েকে ওরা মেরেই ফেলল।

অন্যদিকে শ্বশুর পক্ষের লোকজন মৃত্যুর বিষয়ে সন্দেহাতীত তথ্য, অসাঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ ও বক্তব্য দেওয়ায় এলাকাবাসীর অনেকে ক্ষুব্ধ এবং এই ঘটনাকে রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন।

এলাকাবাসী জানান, বকুলের স্বামী মো. ইসমাঈল আরব আমিরাত প্রবাসী। তিনি আগেও দুইটি বিয়ে করেছে। বকুল ছিল তার ৩য় তম স্ত্রী। তাদের পরিবারে যমজ দুইটি ৫ বছর বয়সী পুত্র সন্তান রয়েছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে কথা হলে তারা প্রথম দিকে বকুলের প্রশংসা করে এবং শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে তার কোন ঝামেলা ও বিরোধ ছিল না বলে জানান। কিন্তু এলাকাবাসীর নানা গুঞ্জন ও প্রশ্নে শেষের দিকে তারা উল্টো বক্তব্য দিতে থাকে। তারা বলে— সে (গৃহবধূ) অবৈধভাবে অন্য একটি ছেলের সাথে ফোনে কথা বলত। কিন্তু এসবের কোন সত্যতা দিতে পারেনি শ্বশুরপক্ষের লোকজন।

বকুলের পরিবার ও স্থানীয়রা বলেন, সত্য ঘটনা আড়াল করতে মিথ্যা কথা বলছেন তারা। উপজেলা স্থাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়ার পর বকুলের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার (২৩ মার্চ) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক সামিউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বকুলের ননদ সাজু আকতার, ননদের জামাই ছৈয়দুল আলম ও আরেকজন মহিলাসহ বকুলকে হাসপাতালে নিয়ে এসে বলেন— ‘বকুল বমি করছিল’। কিন্তু আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি বকুল মৃত। তার মৃত্যুর কথা শুনে বকুলের ননদ সাজু আকতার উল্টো বলেন— ‘সে বমি করেনি, এমনি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। আমাদের লাশ দিয়ে দেন।’ তাদের এমন উল্টোপাল্টা বক্তব্য আমার সন্দেহ হওয়ায় আমি থানায় বিষয়টি জানাই এবং ময়নাতদন্ত করার ব্যবস্থা নিতে বলি। কিন্তু বকুলের সাথে তার ননদসহ যারাই আসছিল সবাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিতে চেয়েছিল। পরে ৯ টার দিকে পুলিশ এসে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়।’

ইসমাঈলের মা আয়শা খাতুন (গৃহবধূর শাশুড়ি) বলেন, ‘বুধবার (২৩ মার্চ) সকালে নামাজ পড়ে দেখি বউ নিজ রুমের বাথরুমের দরজার পাশে বেহুশ অবস্থায় পড়ে আছে। ওই সময় তার মুখে ফেনা ছিল। পুত্র সন্তান দুইজন তার মায়ের পাশে বসা ছিল।’ তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি ‘ধারণা করে’ বলেন, ‘বউ আত্মহত্যা করলে বিষের গন্ধ বা শরীরে দাগ থাকত। কিন্তু এইগুলো তো কিছু নেই।’

শাশুড়ির কথা শেষ না হতেই শ্বশুরপক্ষ থেকে ইসমাঈলের ভাবী খতিজা বেগম বলে উঠলেন— বউ যখন বেহুশ অবস্থায় পড়েছিল তখন সে পায়খানা ও প্রসাব করেছিল এবং তার শরীরে পায়খানা ও প্রসাবের গন্ধ ছিল।’

ইসমাঈলের আগের বউদের প্রসঙ্গে শাশুড়ি আয়শা খাতুন বলেন, ‘প্রথম বউ কান কাটা ছিল তাই সংসারে আনা হয়নি। দ্বিতীয় বউ বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর আর আসেনি।’

এদিকে ইসমাঈলের ২য় স্ত্রীর বাবা মরিয়ম নগর এলাকার জহির আহম্মদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের কোন দোষ ছিলো না। কিন্তু ইসমাঈল ও তার পরিবারের নির্যাতনের কারণে আমার মেয়ে সেখানে থাকতে পারেনি। তারা খুব খারাপ প্রকৃতির মানুষ।’

পোমরা লতিফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা রহিমা, শিল্পী, রুবিসহ অন্তত ৬ জন শিক্ষক ও শিক্ষিকার সাথে কথা হয়েছে। তারা জানান, বকুলও আমাদের স্কুলের ছাত্রী ছিল। সে খুব ভাল, শান্ত ও অমায়িক মেয়ে ছিল। বকুলের মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্কুল থেকে তার ছেলের উপবৃত্তির জন্য তার ভাবী ও ননদের সাথে যোগাযোগ করা হলে বকুলের ডকুমেন্টস আনতে বলা হয়েছিল। বকুলের ননদ ও পরিবারের বড় বউ স্কুলে আসছিল, মায়ের পরিবর্তে ফুফির ডকুমেন্টস দেওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিল ননদ। কিন্তু আমরা বলেছিলাম মায়ের ডকুমেন্টস ছাড়া অন্য কারোর ডকুমেন্টস হবে না। কথার প্রসঙ্গে তার ননদ সাজু আকতার স্কুল ম্যাডামদের বলেছেন— ‘পারিবারিক কারণে বকুলকে তালাক দেয়া হবে। তাই তার নামে করতে চাচ্ছি না।’

এ বিষয়ে বকুলের ননদ সাজু আকতার, ইসমাঈলের বড় ভাবী খতিজা বেগম ও শাশুড়ি আয়শা খাতুনের কাছে জানতে চাইলে তারা এসব কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এসব বকুলের জামাই ইসমাঈলের সিদ্ধান্ত ছিল।’

বকুলের ননদ সাজু আকতার বলেন, ‘আমার ভাই ইসমাঈল বকুলকে ডিভোর্স দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাই বলেছি।’

অথচ এরপর দিনই নিজ শ্বশুর বাড়িতে মারা যান বকুল।

ওই এলাকার ইসলাম খাতুন নামে এক স্থানীয় বলেন, ‘মঙ্গলবার (২২ মার্চ) মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যা ৭ টায় বিয়ের দাওয়াত দিতে যাই তার শ্বশুর বাড়িতে। শাশুড়িকে দাওয়াত দিয়ে বলি— বকুলকে সাথে নিয়ে বিয়েতে যেতে। কিন্তু উত্তরে শাশুড়ি বললেন— ‘তাকে নিয়ে যাব না। তাকে ঘরে তালা মেরে যাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময়ে শ্বশুর বাড়িতে সবার সাথে দেখা হলেও বকুলকে দেখতে পাইনি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার শাশুড়ি বলেন, ‘সে আমার দেবরের বউ তাই মশকারা করেছি।’

এদিকে এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে যারা বকুলের দাফন কাজ করেছেন তারা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স থেকে বকুলের নামানো থেকে শুরু করে গোসল ও দাফন কাজে বকুলের শ্বশুর বাড়ির কোনো লোক এগিয়ে আসেনি। তারা এসব কাজ থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখেছিল। তাছাড়াও বকুলের ননদ সাজু আকতার তার জামাই নিয়ে ২ মাস সে বাসায় ছিল কিন্তু বকুলের মৃত্যুর দিন থেকে তারা সে বাসা ছেড়ে চলে গেছে।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাজু আকতার বলেন, ‘বাবার অসুস্থতার জন্য ছিলাম।’

সাজু আকতারের জামাই ছৈয়দুল আলম ‘কারণে অকারণে বকুলকে শাসাতেন’— এলাকাবাসীর এমন অভিযোগের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছৈয়দুল আলম অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আলমগীর তালুকদার রনি বলেন, ‘বকুলের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পেরে থানায় যাই। বকুল খুব ভাল মেয়ে। গত কিছুদিন আগে তার শ্বশুর বাড়িতে বকুল ও ইসমাঈলের বিষয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে বকুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সে বৈঠকে বকুলকে সামনে না আনায় সেসবের সত্যতা পাইনি। বকুলের শ্বশুর পক্ষের লোকজন বকুলের মা-বাবাকে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলে। যেটা সমীচীন নয়। তাই আমি বৈঠক ফেলে চলে আসি। এছাড়া বকুলের শ্বশুরসহ আমি নিজেও জানাজায় ছিলাম। তবে ননদের জামাইকে জানাজায় দেখা যায়নি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আরও বলেন, ‘বকুলের মৃত্যু যদি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে এর সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমি এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে মানববন্ধন করে যাবো।’

রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহবুব মিলকী জানান, এ বিষয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে হত্যা নাকি আত্মহত্যা জানা যাবে।

আরও পড়ুন