১০ নভেম্বর ২০২৫

রেলের ই-জিপিতে আবার কারসাজি

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

রেলের ই-জিপিতে ৭৫০টি স্টেইনলেস স্টিল (এস.এস) সিটের কারসাজির টেন্ডার শেষ পর্যন্ত রি-টেন্ডারের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। অবান্তর অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে টেন্ডার বাতিলের চেষ্টা করা হয়েছে ডিরেক্টর অব ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল’র (ডিআইসি) দফতর থেকে। ১৭ ফেব্রুয়ারি-২০২২ থেকে ১৫ মার্চ-২০২২ এর মধ্যে টেন্ডার কার্যক্রম শেষ করার কথা। এর মধ্যে রি-টেন্ডারের নীলনক্সা কার্যকর করা হচ্ছে। ২য় সর্বনিম্ন দরদাতার অভিজ্ঞতা থাকার পরও পছন্দের সরবরাহকারীকে দিতে না পারায় রি-টেন্ডারের পাঁয়তারা চলছে। এদিকে চক্রান্তের উদ্দেশে এ ধরনের কারসাজি করায় তদন্তে নেমেছে দুদক— এমন তথ্য পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে।

২য় দরদাতার সবকিছু ঠিক থাকলেও কর্তৃপক্ষ নারাজ। ফলে অদৃশ্য শক্তিতে হার মানানোর অপচেষ্টা টেন্ডার কমিটির। ৩য় সর্বনিম্ন দরদাতাকে দেওয়া হলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে সাড়ে তিন লাখ টাকা। ৪র্থ সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যকর করা হলে সরকারের ক্ষতি হতো প্রায় ১০ লাখ টাকা। চক্রান্তের গুটি নাড়ছে ডিরেক্টর অব ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল’র (ডিআইসি) দফতর থেকে। এসব টেন্ডার কমিটির কারণে কলঙ্কিত হচ্ছে সরকারের ই-জিপি টেন্ডার পক্রিয়া।

অনলাইনে লাইভ দেওয়া টেন্ডারে দেখা গেছে, বাজারে সহজলভ্য পণ্যের আইএসও সহ উৎপাদনকারীর অথরাইজেশন লেটার জমা দিতে হয়েছে টেন্ডারের সঙ্গে। টেন্ডার নিয়ে কারসাজি করছে টেন্ডার কমিটি। উর্ধ্বমুখী ক্রয়াদেশের পাঁয়তারায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার। অথচ ই-জিপিতে ক্রয়ে সরকারের খরচ কমানোর বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে।

এদিকে, দুদক যে বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সেগুলো হল- বাজারে সহজলভ্য জিনিসের কেন উৎপাদনকারীর অথরাইজেশন চাওয়া হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অঙ্কের চুক্তিপত্রের অভিজ্ঞতা কেন চাওয়া হয়েছে, বাজারে সহজলভ্য জিনিসের কেন আইএসও চাওয়া হয়েছে। কারসাজির এমন ক্রয় পক্রিয়ায় সরকারের ক্ষতি নিশ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে। নতুন ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা যেন টেন্ডারে অংশ নিতে না পারে— এমন শর্ত দিয়ে জটিল করার চক্রান্তটি খতিয়ে দেখবে দুদক। বাজারে সহজলভ্য পণ্যের উৎপাদকের বা নির্মাতার ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যার্ন্ডাড অরগানাইজেশন (আইএসও) সার্টিফিকেট চাওয়াটাই ইজিপিতে কর্মকর্তাদের চক্রান্ত এমন অভিযোগ। এমন টেন্ডার ওপেনিং কমিটির চেয়ারম্যান ডিরেক্টর ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল(ডিআইসি) ও মেম্বার সেক্রেটারী ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার অব স্টোর্স (জেনারেল) আসিফ উল ইসলাম।

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়তলীর রেলওয়ে কারখানার জন্য ১০০ এমজি (মিটারগেজ) প্যাসেঞ্জার কোচ মেরামত প্রজেক্টের টেন্ডার আইডি-৬৩১৯২০ টেন্ডারটির ওপেনিংয়ের নির্ধারিত তারিখ ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি। টেন্ডারটির ডকুমেন্ট ফি ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর টেন্ডার সিকিউরিটি ছিল ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রি-টেন্ডার মিটিং হয়েছে ১৮ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু কাদের সঙ্গে এ মিটিং হয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। টেন্ডার ওপেনি অনুযায়ী প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা ইননেট বালাদেশ ৭৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা ২৫ পয়সা, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ঢাকার আহমদ এন্টারপাইজ এই টেন্ডারটি ৭৫ লাখ ৭৫ পয়সা, মাত্র এক টাকার ব্যবধান ৩য় সবনিম্ন দরদাতা প্রথম ও দ্বিতীয় দরদাতার চেয়ে ৩ লাখ ৩ হাজার টাকা বেশি দামে ৭৮ লাখ ৩ হাজার ৫শ’ টাকা ৭৫ পয়সায় দরপত্র দাখিল করেছেন। সবশেষ ৪র্থ দরদাতা সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে পায় ১০ লাখ টাকা বেশি দামে দরপত্র দাখিল করেছেন।

টেন্ডারটির বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসএস সিট মাত্র একটি আইটেমের এই দরপত্রের সিডিউলের পণ্যই বাজারে পর্যাপ্ত থাকার পরও উৎপাদকের অথরাইজেশন সাবমিট করতে বলা হয়েছে। কর্তৃৃপক্ষ নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে চক্রান্ত করছে রেলের ই-জিপি’তে। যেসব শর্ত কোন ভাবেই প্রযোজ্য নয় পিপিআর অনুযায়ী। এ পণ্যের ব্যবসায় খুচরা ও পাইকারী বাজারে শতাধিক আমদানিকারক রয়েছে। ফলে ম্যানুফ্যাকচারারের অথরাইজেশন লেটার চাওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

আরো অভিযোগ রয়েছে, ‘ইলেকট্রনিক টেন্ডার, ঝুট-ঝামেলা নেই আর’ সরকারের এই ধরনের টেন্ডার প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলছে ক্রয় কর্তৃপক্ষ। সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলোতে ক্রয়াদেশ বা ঠিকাকার্য প্রক্রিয়া সহজ করতে সরকার ই-জিপি চালু করলেও বাস্তবায়ন করতে অনীহা অসাধু ক্রয় কর্তৃপক্ষের। ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টে (ই-জিপি) নজরদারি নেই সিপিটিউ কর্তৃপক্ষের। ফলে ই-জিপি’কে জটিল করে তুলছে টেন্ডার কর্তৃপক্ষ। অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেয়ায় ই-জিপি’তে টেন্ডার সাবমিট করতে পারছেন না অনেক ব্যবসায়ী।

টেন্ডার শর্ত অনুযায়ী অভিযোগ রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত এ ধরনের পণ্য লিমিটেড টেন্ডার মেথড (এলটিএম) কিংবা ওটিএম এর মাধ্যমে সরবরাহ করার সুযোগ পেয়েছেন এমন সরবরাহকারীর সংখ্যা দুই বা ততোধিক নয়। টেন্ডার শর্তে বলা হয়েছে, সরবরাহকারীকে অবশ্যই দুই বছরের জেনারেল এক্সপেরিয়েন্স থাকতে হবে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দুটি চুক্তিপত্রে কমপক্ষে এক কোটি টাকা করে পণ্য সরবরাহের নথিপত্র টেন্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকার তরল সম্পত্তি থাকতে হবে। যা ব্যাংক কর্তৃক টেন্ডার সাবমিটের দিনে প্রত্যয়ন পত্র থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির এ টেন্ডার দাখিলের যোগ্যতা হিসেবে সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এমন প্রত্যয়ন পত্রও টেন্ডারের সঙ্গে সন্নিবেশিত করতে হয়েছে। টেন্ডারকৃত পণ্যের জন্য ম্যানুফ্যাকচারারের বা উৎপাদনকারীর অনুমতি পত্র দাখিল করতে হয়েছে।

টেন্ডার ইনফরমেশন ফরম অনুযায়ী দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোন ধরনের মামলায় বা ঝামেলায় জড়িত কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছে। মূলত কোন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের তথ্য দিবে কিনা তা সন্দেহ সরবরাহকারীদের। প্রতিষ্ঠানটির কত বছরের জেনারেল এক্সপেরিয়েন্স রয়েছে, একই ধরনের পণ্যের কতটি চুক্তি রয়েছে, এসব চুক্তির মূল্য কত, কোন সময়ে বা বছরে এসব চুক্তি করা হয়েছে, তরল সম্পত্তির ব্যাক প্রত্যয়ন রয়েছে কিনা। এমন কিছু অবান্তর শর্ত দেওয়া হয়েছে এই টেন্ডারের ডকুমেন্ট সিটে (টিডিএস)।

একাধিক সরবরাহকারী দুটি চুক্তিপত্রে এক কোটি টাকার সমপরিমাণ ও গত তিন বছরে একাধিক সরবরাহকারীর সঙ্গে এমন চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান অভিযোগকারী সরবরাহকারীরা। এ ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়া হলে দুই বা ততোধিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া এ ধরনের দরপত্র আহবানে যোগদান করতে পারবেন না। এমনকি নতুন কোন সরবরাহকারী অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ বঞ্চিত হবেন।

টেন্ডার ডকুমেন্ট সিট (টিডিএস) এর শর্তানুযায়ী এ ই-টেন্ডার অনলাইনে দাখিলের সময় এই পণ্যের ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অরগানাইজেশন (আইএসও) অথবা হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট থাকতে হবে পণ্যের গুণগত মান নির্ধারণে। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পত্রের কপি জমা দিতে হবে। ৯০/১২০ দিনের মধ্যে এই টেন্ডারের কার্যক্রম শেষ করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। টেন্ডার গ্রহীতার যোগ্যতা হিসেবে অনলাইনে সাবমিটের সময় জেনারেল এক্সপেরিয়েন্স, পূর্বে এই পণ্য বা সমজাতীয় পণ্য সরবরাহের দলিলাদি, চুক্তিপত্রের সংখ্যা, চুক্তিপত্রের মূল্য ও সময়, পণ্য সরবরাহের উৎপাদন ক্ষমতা এবং সিডিউল ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত তরল সম্পদ এবং কার্যকরী মূলধনের স্বক্ষমতা প্রত্যয়ন করতে হবে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রথম দফায় ক্রয়যোগ্য পণ্যের নাম নোটিসে উল্লেখ না করেই ঠিকাদার বা সরবরাহকারীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে। ড্যাশ বোর্ডে টেন্ডার প্রস্তুতি বা ডকুমেন্টে ক্লিক করে দেখতে হচ্ছে বিস্তারিত। দরপত্রের প্রাক্কলিত ব্যয়কে মাপকাঠি ধরে সরবরাহকারীদের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করার মত ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ নিয়ম বর্হিভূত। ফলে কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট কোন সরবরাহকারী ব্যতিত অন্য কোন সরবরাহকারী ই-জিপি’তে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না— এমন শর্তারোপের কারণে।

আরো অভিযোগ রয়েছে, সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অধিকমূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তি সম্পাদনের অপচেষ্টা চালাচ্ছে কিনা ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কৌশলে বিতাড়িত করা হচ্ছে সর্বাধিক সরবরাহকারীকে। সরবরাহকারীদের মতে, যেহেতু এই পণ্যের বাজার সর্বত্র রয়েছে সেহেতু কর্তৃপক্ষ বিশেষ কোন সরবরাহকারীর ইচ্ছাকৃত শর্তারোপ না করে সাধারণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সরবরাহকারীদের সুযোগ দিলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ক্রয়াদেশ চুক্তি সম্পাদন সম্ভব।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিরেক্টর ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল (ডিআইসি) ও টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান প্রতিবেদককে বলেন, টেন্ডার ওপেনিংয়ের পর শর্ত নিয়ে কথা বলে কোন লাভ নেই। টেন্ডার ওপেনিংয়ের আগে শর্ত পরিবর্তন করা যেত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। এমন কর্মকাণ্ড অনৈতিক বলা হলে চেয়ারম্যান এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। টেন্ডারের সকল কাগজ এখন ডিজি’র দফতরে রয়েছে। যা রি-টেন্ডার হবে।

আরও পড়ুন