২৪ অক্টোবর ২০২৫

রেলে শতভাগ ইজিপি কার্যকরে চাপাচাপি

বিশেষ প্রতিবেদক »

রেলে ৩৫ হাজার আইটেম ক্রয়ে লিমিটেড টেন্ডার মেথড (এলটিএম) ও ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) এর ওপর চলছে রেড এলার্ট। অঘোষিত হলেও রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের ক্রয় দফতরগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করছে রেলের ডিরেক্টর জেনারেল ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) এর নির্দেশনা। ফলে রেলে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের দরপত্রে ক্রয়াদেশ স্থবির হয়ে রয়েছে। তবে অকেজো যন্ত্রাংশ বিক্রয় আদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের রেড এলার্ট নেই। শ্লথ গতিতে চলছে ইলেকট্রনিক গর্ভমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি)। আবার চালু থাকলেও তা হাতেগোনা কয়েকটি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও কোন কিছু বলতে নারাজ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই। প্রশ্ন উঠেছে, এমন মন্তব্য দায়িত্বশীলদের কে দিবেন?

এদিকে, রেলওয়ে কারখানা ও ডিজেল সপগুলোতে ৮০ ভাগ ইজিপি কার্যকর করে জরুরি ভিত্তিতে মাত্র ২০ ভাগ ক্রয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল এডিজি (আরএস) এর পক্ষ থেকে। কিন্তু এ দুই ধরনের কারখানার জরুরি ভিত্তিতে ক্রয়ের নির্দেশনা বৃটিশ আমল থেকে কার্যকর থাকলেও জরুরি প্রয়োজনে সংগ্রহকৃত পণ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, জরুরি ভিত্তিতে ও অগ্রীম সংগ্রহ করা পণ্যের সিদ্ধান্ত না দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরবরাহকারীরা।

এ ব্যাপারে প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বাংলাধারাকে বলেন, পাহাড়তলীস্থ রেলওয়ে কারখানার কোন টেন্ডারের সঙ্গে আমি জড়িত নই। এ্যানুয়াল প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান (এপিপি) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এ ধরনের কোন ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করিনি। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৮০ লাখ টাকার এপিপি অনুমোদন হয়েছে যা প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলীর অনুমোদন ব্যতিত সম্ভব নয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটাও আমার জানা নেই।

পাহাড়তলীস্থ ক্যারেজ এন্ড ওয়াগনসপ কারখানায় মেরামত করা হচ্ছে যাত্রীবাহী কোচ।

অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনীয় আইটেম ক্রয় বন্ধ করতে এ্যানুয়েল প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান (এপিপি) বন্ধ রেখেছে রেলওয়ে কারখানাসহ ডিজেল সপগুলো। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসাবে সরবরাহকারীরা দুষছেন রেলের বিভিন্ন বিভাগে করোনাকালীন সময়ে ক্রয়কৃত সামগ্রির চুক্তিপত্রের মূল্যায়ন ও অসাধু সরবরাহকারীদের। মূলত অডিট বিভাগের পক্ষ থেকে করোনাকালীন সময়ে ক্রয়কৃত সামগ্রির ওপর তৈরিকৃত তদন্ত রিপোর্টে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি উঠে এসেছে তা খতিয়ে দেখেছে রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি।

আরও অভিযোগ উঠেছে, এ ধরনের রেড এলার্ট জারি করায় রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে নিবন্ধিত প্রায় ২ হাজার সরবরাহকারি ও ঠিকাদার ব্যবসা করতে না পারায় বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, পরিবার পরিজন ছাড়াও নিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের করোনাকালীন সময়কার বেতন বা পারিশ্রমিক প্রদানে হিমশিম খাচ্ছেন। এলটিএম ক্রয় পদ্ধতি ছাড়াও ইজিপিতেও তেমন কোন দরপত্র নেই, যা সরবরাহকারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দরপত্র গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে ক্রান্তিকালীন এ সময়ে সরবরাহকারীরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থই ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, যা কার্যকরি মূলধন হিসাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হত।

আরও অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের ১ অক্টোবর সহকারি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সদর) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠি কার্যকর করা হয়েছে। তবে শতভাগ ইজিপি কার্যকর করা প্রসঙ্গে টেন্ডার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ইজিপি’র ফলে স্বচ্ছতা যেমন বাড়বে তেমনি সরকারী রাজস্বও সাশ্রয় হবে। এছাড়া শতভাগ ইজিপি বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি হবে।

পাহাড়তলীস্থ লোকসেডে ট্রেন ইঞ্জিনের ট্রিপ ইন্সপেকশেন চলছে।

এদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ চতুর্থাংশ সময়ে তথা গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত করোনাকালীন সময়ে কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা পেতে বিভিন্ন সামগ্রি ক্রয় করা হয়েছিল। করোনার আগে যেসব পণ্যের দাম ১০ টাকা ছিল তা দশগুণ বেড়ে যাওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে করোনাকালীন সময়ে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রয়কৃত পণ্যের বাজার মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দরপত্রমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এমন দাবি ক্রয় কমিটির কর্মকর্তাদের।

এছাড়াও ওই সময়ে বাজার যাচাই কমিটির পক্ষ থেকে প্রদত্ত মূল্যায়নকে বিবেচনা করতে গিয়ে ইস্টিমিটেড কস্ট ভ্যালু বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে টেন্ডারের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার মূল্যায়ন কমিটি ও ক্রয় কমিটির মধ্যে দরপত্র নিয়ে কোন সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। দরপত্রদাতা এবং গ্রহীতা উভয়ই ওই মূল্যের ওপর ভিত্তি করে এলটিএম কার্যকর করে পণ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে বাধ্য হয়েছেন।

মূলত করোনাকালীন সময়ের জরুরি পরিস্থিতি পার হওয়ার পর করোনা প্রতিরোধক সামগ্রির মূল্য হ্রাস পাওয়ায় অডিট কর্তৃপক্ষের রিপোর্টে দরপত্র মূল্যের তারতম্য নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।

রেলের ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২০-২১ অর্থ বছরে ক্রয় নীতিমালার আওতায় থাকা এলটিএম ক্রয় সংক্রান্ত দরপত্র স্থগিত করা হয়েছিল। এমনকি ক্রয় সংশ্লিষ্ট দফতর ও ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সরবরাহকারীদের যোগাযোগ প্রত্যক্ষভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্রয় সংক্রান্তে রেলের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পাহাড়তলীস্থ প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের পক্ষে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সদর) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এক অফিস স্মারক প্রকাশ করেছেন গত বছরের ১ অক্টোবর। যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।

এ আদেশে বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী গোপনীয়তা রক্ষার্থে সতর্কতা মূলক প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ও সাঁটানো হয়েছে বিভিন্ন ক্রয় শাখা ও সংশ্লিষ্ট দফতরে।

ওই চিঠিতে বহিরাগত ও সরবরাহকারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের অধীনে ক্রয় বিভাগগুলোতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট (পিপিএ)-২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)-২০০৮ অনুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়েতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় মালামালের ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সরকারি কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন পর্যায়ে তথা সরকারি ক্রয় বিধি মোতাবেক ও গোপনীয়তা রক্ষা করার বিধান রয়েছে। এমতাবস্থায় ক্রয় শাখাসমূহে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারী ব্যতীত সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

শুধু তাই নয়, কোন ধরনের দরপত্রে অংশগ্রহণকারী বা সরবরাহকারীগণের এমনকি প্রতিনিধিদের অনধিকার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া ক্রয় দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পূর্ব অনুমতি ব্যতীত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া কেউ ক্রয় শাখায় প্রবেশ করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, ক্রয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরবরাহকারী বা তার প্রতিনিধিকে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে পূর্ব অনুমতি অথবা নিযুক্তি নিয়ে সাক্ষাত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এ চিঠিতে।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পাহাড়তলীস্থ ডিভিশনাল ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল (ডিআইসি), অতিরিক্ত প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (ক্রয়), ডিস্ট্রিক কন্ট্রোলার অব স্টোরস (ডিসিওএস) জেনারেল, ক্রয়-১, ক্রয়-২ ও পরিদর্শন বিভাগকে বিষয়টি শাখার প্রবেশদ্বারে নোটিশ আকারে ঝোলানো রয়েছে। এছাড়াও এসিস্ট্যান্ট কন্টোলার অব স্টোরসকে (ক্রয়-১, ক্রয়-২ ও ক্রয়-৪), এম এ্যান্ড এস শাখার এসও-১ এবং ২ এর দফতরে অফিস স্মারকটি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল। এ চিঠির অনুলিপি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস), সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক পূর্ব ও পশ্চিমের দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে।

বাংলাধারা/এফএস/এআই

আরও পড়ুন