২৪ অক্টোবর ২০২৫

রেলে ১০ রি-টেন্ডার প্রশ্নবিদ্ধ

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »

টেন্ডার আর রি-টেন্ডারের মধ্যদিয়ে চলছে রেলের ১০০ এমজি মেরামত প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া। দরদাতাদের ইচ্ছাকৃত ও অহেতুক শর্তের কারণে আর ঠিকাদার বা সরবরাহকারীদের আকস্মিক অযোগ্যতার কারণ সৃষ্টি করে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইলেকট্রনিক সরকারী ক্রয় (ইজিপি) প্রক্রিয়াকে কুলষিত করতে এমন চক্রান্ত করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অন্যথায় একই টেন্ডার বার বার রি-টেন্ডার করার পেছনে ঘুষ বাণিজ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, গত তিন থেকে ছয় মাস আগে যেসব টেন্ডার ইজিপি’র অনলাইনে ছিল সেসব টেন্ডার নানা অজুহাতে বাতিল করে আবার রি-টেন্ডার হয়ে অনলাইনের লাইভে চলে এসেছে। প্রায় ৩/৬ মাস পর লাইভে আসায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত প্রায় ২০/২৫টি টেন্ডার ১০০এমজি মেরামত প্রকল্পের আওতায় আসে। এর মধ্যে ১০টি টেন্ডারই আবার রি-টেন্ডারের ঘটনায় সরবরাহকারীদের মাঝে নানা প্রশ্নের উদ্রেক সৃষ্টি করেছে। এছাড়া লাখ লাখ টাকার টেন্ডার সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ আটকে রাখার কারনে সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের(সিপিটিইউ) ওয়েব সাইটের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, রেলের ১০০এমজি মেরামত প্রকল্পে চলছে টেন্ডার নিয়ে দফায় দফায় রি-টেন্ডারের খেলা। ডিরেক্টর অব ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল(ডিআইসি) প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম ১০টি রি-টেন্ডারের তালিকা অনলাইনে লাইভ করেছেন নোটিস আকারে। সে অনুযায়ী সর্বশেষ গত ৬ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এ ১০টি রি-টেন্ডারের ওপেনিং ছিল।

এ ব্যাপারে টেন্ডার কমিটির এক সদস্য বলেন, বিশেষ কিছু কারণে শর্ত দেওয়া হয়। অনেক বিডার না পারলেও টেন্ডারে অংশ নিয়ে টেন্ডারকে ভুণ্ডুল করার চেষ্টা করে। এছাড়াও রাজনৈতিক কিছু চাপও আছে যাদের টেন্ডার পাইয়ে দিতে আমাদেরকে এমন শর্ত জুড়ে দিতে হয়। তবে এটা আমার পছন্দ নয় কিন্তু ডিআইসি এসব শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। তবে শর্ত ছাড়াই এসব টেন্ডার কার্যকর করা সম্ভব। সিপিটিইউ’র আওতাভুক্ত রেল মন্ত্রনালয়ের অধীনে থাকা ১০০এমজি প্রকল্পে কোচ মেরামতের জন্য।

প্রথমত, গত ৯ জুন ইলেকট্রিক্যাল আইটেমের ইজিপি টেন্ডার নং-৬৯৯৭১৩ এর ওপেনিং ছিল। এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি এক হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে এক লাখ টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ১২ জুন থেকে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, বিসিক নিবন্ধন সার্টিফিকেট ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা ও ২৫ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ২০ লাখ টাকার ইলেকট্রিক্যাল পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

দ্বিতীয়ত, গত ৯ জুন আরেকটি ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল প্যানেল ট্রান্সফরমার ও এমএস সিটসহ নানা আইটেমের ইজিপি টেন্ডার নং-৬৯৯৭১২ এর ওপেনিং ছিল। এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি এক হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ১২জুন থেকে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অরগানাইজেশন (আইএসও) সনদ, ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, আইএসও সার্টিফিকেট ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

তৃতীয়ত, গত ৮ জুন ইলেকট্রিক্যাল আইটেমের আরেকটি টেন্ডার ওপেনিং ছিল। ৭০০ ক্যারেজ সিলিং ফ্যান ও ৭০০ এমএস বেস প্লেট ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ১২জুন থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, বিসিক নিবন্ধন সার্টিফিকেট, আইএসও ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭৫ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৫০ লাখ টাকার ইলেকট্রিক্যাল পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

চতুর্থত, গত ৮ জুন ওয়েলডিং ও অগ্নি নির্বাপনসহ নানা আইটেমের ইজিপি টেন্ডার নং- ৬৯৯৭১৮ এর ওপেনিং ছিল। এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি এক হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৯ জুন থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অরগানাইজেশন(আইএসও) সনদ, ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ২০ লাখ ও ব্যাংক প্রত্যয়ন ১৫ লাখ টাকা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

পঞ্চমত, গত ৭ জুন ইস্পাত চ্যানেল ও চেকার্ড প্লেট আইটেমের ইজিপি টেন্ডার নং- ৬৯৯৭১৬ এর ওপেনিং ছিল। এ ক্রয়ের জন্য টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি এক হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৮ জুন থেকে ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, আইএসও ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা ও ২৫ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ২০ লাখ টাকার লৌহজাত পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

ষষ্ঠত, গত ৬ জুন এমজি কোচের এসএস উইন্ডো সাটার বডি ও ডোর সাইড, উইন্ডো কমপ্লিট এবং ল্যাবরেটোরি আইটেমের আরেকটি ইজিপি টেন্ডার নং- ৭০২০০৮ এর ওপেনিং ছিল। বিভিন্ন আইটেমের এসএস জানালা ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার ৫০০ টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৭জুন থেকে ৭ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৬০ লাখ টাকা ও ৬০ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৫০ লাখ টাকার এ ধরনের পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

সপ্তমত, গত ৬ জুন ট্রেনের বগির বিভিন্ন আইটেমের আরেকটি ইজিপি টেন্ডার নং- ৭০১৭৩০ এর ওপেনিং ছিল। বিভিন্ন ধরনের এলেক্স বক্স, ওয়্যারিং প্লেট ও ব্র্যাকেট ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৭ জুন থেকে ২৮ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ও ৭৫ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৫০ লাখ টাকার বগির পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

অষ্টমত, গত ৬ জুন এমজি কোচের এসএস হাই/লো কমোড, হ্যান্ডেল, ডোরসহ বিভিন্ন আইটেমের আরেকটি ইজিপি টেন্ডার নং- ৭০১৭২৬ এর ওপেনিং ছিল। এই টেন্ডারে মেইনডোর এসএস হ্যান্ডেল সিএমই/২৭০৬ মডেলের মোট ৫৫০টি ক্রয়ের জন্য দুইবার দেখানো হয়েছে। এমনকি কোন ধরনের সংশোধনীও দেওয়া হয়নি এমন অভিযোগ করেছেন এক সরবরাহকারী। এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ১৫জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। মাত্র ১৫দিনে এ টেন্ডারের সমুদয় কার্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে ছিল যথেষ্ট সংশয়। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ও ৫০ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৪০ লাখ টাকার পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

নবমত, গত ৬ জুন ইলেকট্রিক্যাল আইটেমের আরেকটি ইজিপি টেন্ডার নং- ৬২৬৭৫০ এর ওপেনিং ছিল। ফিডার লাইন কন্ট্রোল প্যানেল ও ডাবল ডোর কেবিনেট ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৭জুন থেকে ৩০জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ও ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৩০ লাখ টাকার ইলেকট্রিক্যাল পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের।

দশমত, গত ৬ জুন ৭৫০টি এসএস সিট ডোব টেইল মডেলের আইটেমের আরেকটি ইজিপি টেন্ডার নং- ৬৯৯৭০৯ এর ওপেনিং ছিল। এই এসএস সিট ক্রয়ের জন্য এই টেন্ডারের জন্য ডকুমেন্ট ফি দুই হাজার টাকা ও টেন্ডার সিকিউরিটি নেওয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। যা মাত্র ৫৪ দিনের মধ্যেই রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। ওপেনিংয়ের পর টেন্ডারটি ৭ জুন থেকে ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ম্যানুফ্যাকচার/ডিলারের অথরাইজেশন, আইএসও ও হোম স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে।

এ টেন্ডার শর্তে তরল সম্পত্তি কমপক্ষে ৬৫ লাখ টাকা ও ৭৫ লাখ টাকার ব্যাংক প্রত্যয়ন, ২ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ৫০ লাখ টাকার এ ধরনের পণ্য সরবরাহের চুক্তিনামা থাকতে হবে টেন্ডার বিডারদের। প্রশ্ন উঠেছে এই টেন্ডারটি গত মার্চ মাসে প্রথমবারের মত ওপেনিংয়ের তারিখ ছিল। দীর্ঘ তিন মাস পর রিলিজ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এবার কেন টেন্ডার সিকিউরিট তাড়াহুড়ো করে রিলিজ করা হয়েছে। আবার মাত্র ১৫ কার্য দিবসে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হচ্ছে। সরবরাহকারীদের প্রশ্ন সর্ষের মধ্যে ভূত নেইতো।

আরও পড়ুন