২৩ অক্টোবর ২০২৫

অর্ধযুগে বেড়েছে খুনাখুনি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ অভিযান শুরু

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে প্রায়ই ঘটছে হত্যা-সংঘর্ষ। অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে একাধিক গ্রুপ। চলমান রোহিঙ্গা সংকটের ৬ বছর অতিক্রম হলেও প্রত্যাবাসন বিষয়ে আশার আলো নেই। ফলে অপরাধ কর্মের কারণে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রিত দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যাবাসনে বিলম্ব দেখায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়ে পরিচয় গোপন করে কৌশলে নিচ্ছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট। তাই দিনে দিনে চরম বিষফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে রোহিঙ্গারা।

আইনশৃংখলা বাহিনী সূত্র মতে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে গত ছয় বছরে দু’শতাধিক রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালানের টাকা ভাগাভাগির জের ধরেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটেছে। আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের মিয়ানমার ভিত্তিক দুটি প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপগোষ্ঠী হিসেবে আরও ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে-ই চলছে।

এমন পরিস্থিতিতে শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত যৌথ অভিযান চালিয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), জেলা পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আনসার ভিডিপি সদস্যরা।

ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পের শান্তিশৃঙ্খলা স্থিতিরাখা, মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে শনিবার বিকেল হতে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। প্রথমদিন ১৪ এপিবিএন নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বিশেষ অভিযানের সূত্রপাত করা হয়। এপিবিএনকে সহযোগিতা করতে জেলা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার ভিডিপি সদস্যরা অভিযানে অংশ নেন। উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে যেকোন সময় এ অভিযান চলবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে।

১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ক্যাম্পে ঘটমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ অভিযানের সিদ্ধান্ত হয় গত মঙ্গলবারের বিশেষ সমন্বয় সভায়। চলমান রোহিঙ্গা সংকটের ৬ষ্ঠ বছর উদযাপনের পরই অভিযান শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। সেমতে শনিবার অভিযান শুরু হয়েছে। শৃংখলা বজায় রাখার পাশাপাশি অপরাধীরা যেন ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে, সে জন্য কেটে ফেলা কাঁটাতারের বেড়া সংস্কার, প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরাযুক্ত পর্যবেক্ষণ চৌকি চালু ও যাতায়াতের সংযোগ সড়কগুলোয় একাধিক তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত ডিআইজি আরো বলেন, প্রথম দিনের অভিযান চলে বৈরী আবহাওয়ায়। এ কারণে উল্লেখ করার মতো এসিভম্যান্ট না থাকলেও সবার মাঝে অভিযানের ম্যাসেজ গেছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। গত বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়ার পালংখালী থেকে আরসার অর্থসম্পাদক হিসেবে পরিচিত মাওলানা ইউনুসকে পাকিস্তনের তৈরি একটি রিভলবারসহ গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। আমরা তৈরী রয়েছি, সবার সমন্বয়ে একেক সময় একেকটি ক্যাম্পে অভিযান চলমান থাকবে।

প্রত্যাবাসন প্রিয় রোহিঙ্গাদের মতে, ক্যাম্পের নিরাপত্তায় কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হলেও অনেক ক্যাম্পের সুবিধাজনক স্থানে কেটে পথ করা হয়েছে। আরসা, আরএসও ও অন্যান্য সন্ত্রাসীবাহিনীর সদস্যরা সুবিধাজনক সময়ে তারের কাটা অংশ দিয়ে ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করে। এসময় হত্যা, অপহরণসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে নিরাপদ আস্তানায় চলে যায় তারা। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর গত ছয় বছরে আরসার সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হলেও অপরাধীদের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। তাতে আতংকিত সময় কাটে সাধারণ রোহিঙ্গাদের। রাত হলে ক্যাম্পগুলো অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে (ক্যাম্প-৮) আরসার সন্ত্রাসীরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মো. ইউসুফ (১৬) নামের এক রোহিঙ্গা কিশোরকে। ক্যাম্পে চলমান মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইউসুফ আরএসও সদস্য বলে দাবি রোহিঙ্গা নেতাদের। সে ওই ক্যাম্পের এইচ-১৭ ব্লকের হামিদ হোসেনের ছেলে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে ক্যাম্পগুলোয় অর্ধশতাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ খুনের ঘটনা আরসার সঙ্গে আরএসও এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন এবং মুন্না বাহিনীর সাথে অন্যদের মধ্যে। সংঘর্ষে আরসার ১৮সদস্য, আরএসওর দুজন নিহত হন বলে দাবি রয়েছে। ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোয় সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা।

ইউএনএইচসিআর’র বরাত দিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৮লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত ছয় বছরে সবকটি ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে।

পুলিশ জানায়, ২০২১ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে আরসা সন্ত্রাসীরা গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পর দিন ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। গত ১৪ জুন কক্সবাজার আদালতে আরসার ২৯ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে উখিয়া থানা-পুলিশ। তবে নাম-ঠিকানা শনাক্ত না হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আহাম্মার জুনুনিসহ সাতজনের নাম বাদ দেয়া হয়।

মুহিবুল্লাহ খুনের একমাস না পেরোতেই ২২ অক্টোবর বালুখালীর (ক্যাম্প-১৮) দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ছয়জন মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রকে। এ ঘটনায় আরসাকে দায়ী করা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই দুটি হত্যাকান্ডে ঘটনায় আরসার তিনজন ক্যাম্প কমান্ডারসহ অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন ও উখিয়া থানার পুলিশ।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ, ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোতা নবী হোসেন বাহিনীর প্রধান রোহিঙ্গা নবী হোসেনের বিরুদ্ধে এই থানায় চারটি হত্যাসহ প্রায় পাঁচ-ছয়টি মামলা আছে। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তে শূন্যরেখাতে অবস্থান করায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।

ওসি আলী আরো বলেন, শুরুর তুলনায় ক্যাম্পে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। ২০১৭ সালে হত্যাকান্ডে ৮ মামলায় আসামি ছিল ২২ জন। ২০১৮ সালে ১৫ হত্যা মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ হত্যা মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ হত্যা মামলাতে আসামি ২৩৭ জন এবং চলতি ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত পৌনে আট মাসে ৪০টি হত্যা মামলাতে আসামি করা হয় ৪০৪ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে। এ ছাড়াও গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরে ৪৪টি অপহরণ, ৯৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ২৩৮টি অস্ত্র মামলাতে আসামি করা হয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গাকে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিদেশি অনুদান এবং মাদক চোরাচালান থেকে পাওয়া টাকায় উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে আরসার তৎপরতা বেড়েছে। প্রতিমাসে আসা টাকায় কেনা হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ, যা দিয়ে মাঝেমাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে শক্তি জানান দেয় আরসা। গত ৩ আগস্ট রাতে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে এপিবিএনের সঙ্গে আরসার সন্ত্রাসীদের আড়াই ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরসার তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে অস্ত্র, ইয়াবাসহ বেশ কিছু অপরাধী ধরাও পড়েছে। এখন থেকে সমন্বয় করে সময়ে সময়ে একেক ক্যাম্পে অভিযান চালানো হবে।

আরও পড়ুন