২৯ অক্টোবর ২০২৫

রোহিঙ্গা পল্লীতে করোনার থাবা

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

এত কঠোর তদারকির পরও অবশেষে রোহিঙ্গাদের মাঝে থাবা বসিয়েছে চলমান বিশ্ব আতংক প্রাণঘাতি করোনা। গাত ১৪ মে (বৃহস্পতিবার) উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এক তরুণ রোহিঙ্গার করোনা ‘পজেটিভ’ রিপোর্ট আসার একদিনের মাথায় শুক্রবার (১৫ মে) আরো ৩ রোহিঙ্গার করোনা পজিটিভ মিলেছে।

এদিন পরীক্ষা করা ১৮৪ জনের স্যাম্পলের মাঝে নতুন ২১ জনের রিপোর্ট ‘পজেটিভ’ পাওয়া যায়। এছাড়াও রামু’র ২ জন পুরাতন করোনা রোগীর ফলোআপ রিপোর্ট ‘পজেটিভ’ এলেও বাকি নেগেটিভ ১৬১ জনের রিপোর্ট এসেছে নেগেটিভ।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া জানিয়েছেন, শুক্রবার (১৫ মে) ‘পজেটিভ’ রিপোর্ট পাওয়া ২১জন করোনা রোগীর মধ্যে কক্সবাজার সদর উপজেলায় ১ জন, চকরিয়া উপজেলায় ১৫ জন, পেকুয়া উপজেলায় ১ জন, কুতুবদিয়ায় ১ জন এবং রোহিঙ্গা শরনার্থী ৩ জন। এ নিয়ে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ল্যাবে পরীক্ষায় ১৫ মে পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৬৮ জন।

‘এতে কক্সবাজার জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৫২ জন। এরমধ্যে চকরিয়া উপজেলায় ৫২ জন, কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৩৬ জন, পেকুয়া উপজেলায় ২১ জন, মহেশখালী উপজেলায় ১২ জন, উখিয়া উপজেলায় ১৪ জন, টেকনাফ উপজেলায় ৭ জন, রামু উপজেলায় ৪ জন, কুতুবদিয়া উপজেলায় ১ জন এবং রোহিঙ্গা শরনার্থী ৪ জন। কুতুবদিয়া উপজেলায় আজই প্রথম ১ জন করোনা পজিটিভ সনাক্ত হলো।’

এদিকে, দীর্ঘ কঠোরতার পরও ক্যাম্পের গাদাগাদি বাসে করোনা পজিটিভ আসায় স্থানীয়দের মাঝে আতংক বিরাজ করলেও শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার হতাশ বা আতংকিত নন বলে উল্লেখ করেছেন।

রোহিঙ্গাদের মাঝে সামনে আরো আক্রান্ত হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চিকিৎসার মাধ্যমে করোনাকে জয় করার প্রস্তুতি ক্যাম্প এলাকায় নেয়া রয়েছে। বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্রে যেখানে করোনা অপ্রতিরোধ্য সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনার হানাকে বড় করে দেখা উচিত নয়। সচেতনতার সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে করোনা মোকাবিলা করাই এখন লক্ষ্য বলে দাবি করেছেন তিনি।

তবে, প্রথম এবং শুক্রবারে পজিটিভ রোহিঙ্গারা কিভাবে আক্রান্ত হয়েছে বিষয়টি এখনো অজানা মন্তব্য করে আরআরআরসি বলেন, সেটি বের করার চেষ্টা চলছে। পজিটিভ আসাদের আইসোলেশনে নেয়ার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে আসাদের সনাক্ত করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এদিকে, করোনার যাত্রা থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর শরণার্থী শিবির ১১ লাখাধিক রোহিঙ্গাকে নিয়ে বাংলাদেশের মতো জাতিসংঘও আতংক প্রকাশ করেছিল। কারণ, অসচেতন জাতি গোষ্টি হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণ হলে তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল বলে দাবি করা হচ্ছিল বার বার। ক্যাম্পে করোনার সংক্রমণ হলে এর প্রভাব স্থানীয়দের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ার চরম আশঙ্কা ছিলো এবং এখনো রয়েছে। অবশেষে করোনা থাবা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পড়ায় বেশ গুঞ্জন চলছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এনজিও এবং স্থানীয়রাও এতে বেশ উদ্বিগ্ন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) উখিয়া উপজেলা সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, উখিয়া-টেকনাফে যেহেতু মানবিক আশ্রয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে সেহেতু গণ সংক্রমণের আশঙ্কায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে করোনা মুক্ত রাখতে জেলা প্রশাসন শুরুতেই লকডাউনের ব্যবস্থা করেছিল। সবকিছুতে কঠোরতা থাকায় বিগত দু’মাসেরও বেশি সময় ক্যাম্পে করোনার লক্ষ্মণ কারো মাঝে স্থিতি পায়নি। কিন্তু শেষমেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনার থাবা আশপাশ এলাকায় আতংক ছড়াচ্ছে। নির্দিষ্ট জায়গায় স্থিতি থাকা রোহিঙ্গা সংক্রমণ হওয়ার কারণ খুঁজতে মরিয়া সবাই।

সুজন সভাপতির মতে, শুরু থেকেই আশঙ্কা ছিলো, ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দ্বারাই রোহিঙ্গাদের মাঝে করোনা সংক্রমণ হতে পারে। রোহিঙ্গার মাঝে করোনা পজিটিভ আসার পর ‘কিভাবে সংক্রমণ’ হলো সে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়েছে। সবার অদৃশ্য ইঙ্গিত ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দিকে। যারা দেশের করোনা প্রাদূর্ভাব থাকা এলাকা থেকে নিষেধাজ্ঞার সময়েও ক্যাম্প এলাকায় এসেছে এবং প্রশাসনের অগোচরে ক্যাম্পে কাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন সমাজকর্মী বলেন, লকডাউনের শুরুতে জেলার বাইরের থাকা অনেক এনজিও কর্মী নিষেধাজ্ঞা সত্তেও গোপনে কক্সবাজার এসেছেন এবং ক্যাম্পে গিয়ে কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন। তাই ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণে এনজিও কর্মীদেরই ‘দায়ী’ মনে করা হচ্ছে। আবার যে রোহিঙ্গা যুবক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তার বাস স্থানীয় শাহপরীরদ্বীপ পাড়ার লাগোয়া। রোহিঙ্গারা এক জায়গায় থাকলেও শাহপরীরদ্বীপ পাড়ার লোকজনের বিচরণ সবখানে ছিল। আবার সে পাড়ায় কয়েক বাড়িতে কাজও করেছে আক্রান্ত যুবক। এজন্য সে পাড়ায় কেউ আক্রান্ত কিনা সেটিও সচেতন মহলকে ভাবাচ্ছে এবং আতংক ভর করেছে বলে উল্লেখ করেন তারা।

অপরদিকে, এনজিওকর্মীদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা সংক্রমিত হওয়ার যুক্তিকতা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেনজানতে আরআরআরসি অফিসের প্রধান স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মোহাম্মদ তোহা। তার মতে, বাইরে থেকে কক্সবাজার আসা এনজিও কর্মীরদের সনাক্তের পর নির্দিষ্ট সময় কোয়ারাইন্টাইন শেষ করেই ক্যাম্পে ঢুকানো হয়েছে। তবে আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বাইরের বের হওয়ার ‘হিস্ট্রি’ও পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে ডা. তোহা বলেন, আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হবার চেষ্টা চালাচ্ছি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের মানবিক আশ্রয়ে রয়েছেন। তাই ক্যাম্পে করোনার সংক্রমণ রোধে শুরু থেকে প্রচেষ্টা ছিল এবং আমরা দীর্ঘ দু’মাস সফলও ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ যেহেতু ক্যাম্পে করোনা সনাক্ত হয়েছে সেহেতু তা আরআরআরসি অফিস দেখভাল করছে। ক্যাম্পে আগে থেকে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্যাম্পে করোনার প্রাদূর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আগের মতোই কঠোরতায় কাজ চলমান রয়েছে। আরআরআরসি অফিসের সাথে জেলা প্রশাসন ও শৃংখলাবাহিনীর সমন্বয় আগের মতোই রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এডিসি আশরাফুল।

এদিকে, রোহিঙ্গার করোনা পজিটিভ হওয়ার কারণ খুঁজতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যাম্প ভিত্তিক দায়িত্বশীলরাও। আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক চলাফেরার চালচিত্র অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে তারা এমনটি জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

অপরদিকে, বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা হিসেবে রিপোর্ট পজিটিভ আসা আরেকজন রোহিঙ্গা নন বলে দাবি করেছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তার কার্যালয়। তিনি (অপর আক্রান্ত) এনজিও এমএসএফ হাসপাতালের মাধ্যমে সিম্পল পাঠানো কালে ঠিকানা কেপিসি-(কুতুপালং ক্যাম্প) লেখায় তাকেও রোহিঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল বলে দাবি করে আরআরআরসি কার্যালয়।

ক্যাম্পে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী কোন বড়ুয়ার বাস না থাকায় পরবর্তীতে তিনি রোহিঙ্গা নন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি পার্বত্য নাইক্যছড়ির উখিয়া সীমান্তের ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দা এবং ক্যাম্প এলাকায় ব্যবসা করেন বলে প্রমাণ মিলেছে।

উল্লেখ্য, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে ল্যাব প্রতিষ্ঠার পর গত ৪৫ দিনে মোট ৩ হাজার ৫৪৬ জনের স্যাম্পল টেস্ট করা হয়েছে। পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া গেছে ১৬৮ জনের। এতে কক্সবাজার জেলার ১৫২ জন। পজিটিভ আসাদের মাঝে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে আইসোলেশন থেকে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ৪০ জন।

বালাধারা/এফএস/টিএম/এএ

আরও পড়ুন