নিজস্ব প্রতিবেদক »
চট্টগ্রামের ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমন। নগরীর অনেকেই তাকে চেনেন ‘লাইভ কাউন্সিলর’ বা ‘লাইভ রোগী’ হিসেবে। কারণ লাইভে এসে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যিনি ওয়ার্ডবাসীর উপকারের পাশাপাশি তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন উল্টো বিপদেও। এমনই এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে এবার জামালখানবাসী।
‘বাংলাদেশ দেখবে জামালখান’ স্লোগানে ওয়ার্ড সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া কাউন্সিলর এবার নিজেই বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন নিজের এলাবাসীকে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আল্টিমেটাম ছাড়াই জামালখানের ঝুলন্ত ইন্টারনেট ও ডিশের তার কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন তিনি। যার ফলে মহাবিপদে পড়েছে ওই এলাকায় অবস্থিত ব্যাংক, ক্লিনিক, মিডিয়া হাউসসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) দুপুর ১টার দিকে ফেসবুক লাইভে আসেন কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমন। এসময় ৪৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের ফেসবুক লাইভের ওই ভিডিওতে ওয়ার্ডের সব ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
এরপরপরই তার নির্দেশে চেরাগী পাহাড় মোড় থেকে জামালখান লিচুবাগান পর্যন্ত সব ঝুলন্ত ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার কেটে দেয় সিটি করপোরেশনের বৈদ্যুতিক বাতি সংযোগের কাজে নিয়োজিত কর্মীরা।
সরেজমিনে জামালখান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এভাবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হুট করে ইন্টারনেট ও ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকাবাসী। অনেকেই এটিএম বুথে জরুরি টাকা তুলতে গিয়ে ফিরে এসেছেন খালি হাতে। ইন্টারনেট সেবা না থাকায় ব্যাংকের লেনদেনও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এমন কাণ্ডে মুখ থুবড়ে পড়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
আল রহমান নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘টিভিতে বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেলই দেখতে পাচ্ছিনা। এদিকে ইন্টারনেটও ব্যবহার করতে পারছিনা। পুরো বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে। এই কাণ্ড আমাদের নাগরিক অধিকার হরণ। উনি কাউন্সিলর হিসেবে আমাদের ভাল-মন্দ দেখার কথা। কিন্তু পূর্বঘোষণা ছাড়া এ কাজ কখনই উনি করতে পারেন না।’
এদিকে কাউন্সিলরকে ‘লাইভ রোগী’ আখ্যা দিয়ে সাদমান রহমান সময় নামে এক ব্যক্তি ফেসবুক লাইভের কমেন্টে লিখেছেন, ‘এটা ঠিক হলো না৷ আপনি যেটা করলেন সেটা মাস্তানি৷ এটা আপনার লাইভ রোগ তা আজ বোঝা গেলো। আগে অন্য সমাধান ব্যবস্থা করতেন তারপর করতেন এসব৷’
শাওন নামে একজন মন্তব্য করেন, ‘তাহলে আপনি এতো দিন চোখ এর সামনে এই গুলো কি কারণে প্রশ্রয় দিয়েছেন? আনেক অফিস, বাড়ি, ককর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারটা মাথায় রেখে সময় দিয়ে কাজ করা উচিত ছিলো।’
এ ঘটনার পর ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএ) একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। সংগঠনের
সহ-সভাপতি আনোয়ারুল আজিম ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় আহবায়ক রাজিব শাহরিয়ার রুবেন্স স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে কমিশনার (কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন) কর্তৃক ফাইবার ক্যাবল কাটার কারণে জামালখান এলাকার বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ আছে। আইএসপিএ’র টেকনিশিয়ানরা ফাইবার পুনঃস্থাপনের কাজে গেলে ওয়ার্ড কমিশনার বাধা দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আইএসপিএ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পরবর্তী না দেয়া পর্যন্ত অ্যাসোসিয়েশনের সকল সদস্যকে জামালখান ওয়ার্ডে ফাইবার পুনঃস্থাপন ও মেইনটেন্যান্স, নতুন সংযোগ প্রদানসহ সকল ধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইন্টারনেট ও টেলিভিশনের স্যাটেলাইট সংযোগের তার অপসারণ করায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার ফ্রিল্যান্সাররা। বিশ্লেষকদের মতে, গ্রাহকদের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় না এনে, ইন্টারনেট সংযোগের বিকল্প ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে ইন্টারনেটের ক্যাবল কেটে ফেলে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা একটি অপরাধের সামিল।
এ বিষয়ে ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন সিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল কুমার পালিত বাংলাধারাকে বলেন, ‘এটি নিয়ে গতকাল মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তিনি ডেকেছিলেন রাতে। এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য তিনি নিজেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটি তার (মেয়র) জানা ছিল না। কাউন্সিলর জানানোর পর মেয়র মহোদয় কাউন্সিলরকে বলেছেন, কাজটি তিনি ঠিক করেননি।
তিনি বলেন, ‘গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকে আজ (শুক্রবার) বিকেল পর্যন্ত ২-৩ জন অপারেটরের লাইন এখনও চালু হয়নি। একটি ক্যাবলের মধ্যে ৪৮টি ফাইবার পোর্ট থাকে। সেই ক্যাবল যখন তিন জায়গায় কাটা পড়ে তখন সেটি রিস্টোর করা কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন ক্যাবল দিয়ে লাইন চালু করতে গতকাল সারারাত গেছে। এখনও ৩-৪ জনের লাইন চালু করা সম্ভব হয়নি। গ্রাহকদের মনে আমাদের ওপর ক্ষোভ হয়েছে। পরবর্তীতে লাইন ঠিক করতে গেলে আমাদের লোকদের বাধা না দিলেও অন্যদের কাউন্সিলর বাধা দিয়েছে বলে শুনেছি।’
‘আমরা যৌথভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমরা একটি প্রতিকী প্রতিবাদে যাব। কিন্তু পরে যেহেতু মেয়র মহোদয় দুঃখ প্রকাশ করেছ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন সেহেতু আমরা সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি তার আশ্বাসে। কাউন্সিলরের এ কাজের কারণে আমাদের আর্থিক ক্ষতি অনেক হয়েছে। যে ফাইবার কেটেছে সে ফাইবার দেশে পাওয়া যায়না। সেগুলো ইউএসএ থেকে আনানো হয়েছিলো। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের গ্রাহকরাও দুর্ভোগের শিকার হয়েছে।’—যোগ করেন তিনি।
শ্যামল কুমার পালিত বলেন, ‘আমার সঙ্গে কাউন্সিলরের কথা হয়েছিল। সে বলেছিল ঝুলে থাকা ইন্টারনেটের তার কেটেছে। আমাদের সিসিএল’র ক্যাবল কাটেনি। পরে দেখা গেল, ঝুলে থাকা ক্যাবল কোনগুলি কেটেছে আমি ঠিক বলতে পারবোনা। ওখানে অনেকগুলো ক্যাবল কেটেছে। কিন্তু আমাদের ক্যাবলটা ঝুলানো ক্যাবল না। এটা মেইন লাইন। এটার সম্প্রচার লাইন জুবলি রোড থেকে জামালখান-চকবাজার হয়ে কালুরঘাট সেতু পার হয়ে বোয়ালখালী পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্যাবল কাটার পর অনেক ক্যাবল খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছেনা। কেটে ফেলে দিয়েছে তারা।’
‘আমরা সৌন্দর্যবর্ধনের বিপক্ষে না। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর যে কাজটা করছে সেটাও জনগণের জন্য করছে। এতে আমাদের বাধা নেই। কিন্তু এখানে জিনিসটা সমন্বয়ের অভাব। আগে যদি আমাদের সাথে আলাপ করতো, বলতো তো এখানে এই ঝুলে থাকা ফাইবারগুলি পরিত্যক্ত কিনা বা এগুলি কাজের কিনা… একটু খোঁজ নিয়ে যদি কাটতো আমাদের এত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না।’—বলেন তিনি।
ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন সিএমসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন মাসুদ বাংলাধারাকে বলেন, ‘আমাদের সাথে লাইন কাটার ব্যাপারে পূর্বে কথা হয়নি কাউন্সিলরের সঙ্গে। অনেকগুলো আইএসপি এবং ক্যাবল টিভির লাইন ছিল সেখানে। আনুমানিক ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমাদের।’
‘গতকাল মেয়র মহোদয় ডেকেছিলেন বৈঠকে। আমি চট্টগ্রাম না থাকায় আমার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলাম। এটা ভবিষ্যতে আর হবেনা বলে মেয়র মহোদয় কথা দিয়েছেন। আমরা প্রথমে মেরামতের কাজ করবোনা ভেবেছিলাম। কিন্তু মেয়র মহোদয় যেহেতু আশ্বাস দিয়েছেন সেহেতু গ্রাহকদের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে আমরা মেরামতের কাজ শুরু করি। এখন সব স্বাভাবিক রয়েছে।’
কোনপ্রকার সমন্বয় ছাড়া এভাবে লাইভে এসে হুট করে ইন্টারনেট ও ডিশের তার কাটার ব্যাপারে জানতে চসিকের ২১ নম্বর জামাল খান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলে সেটির সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে তার ব্যবহৃত নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য জানতে চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তার পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাধারা/আরএইচআর