তারেক মাহমুদ »
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থানে ডুবে থাকা অসংখ্য নৌযান উদ্ধার ও পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইন অপসারণে তৎকালীন সোভিয়েত নৌবাহিনীর একটি টিম চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। মাইন উদ্ধার করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই সোভিয়েত উদ্ধারকারী নৌবাহিনীর নাবিক ইউরি রেডকিন বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। পরবর্তীতে তাঁর লাশ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া হয়নি। বাংলাদেশ-রাশিয়া সরকারের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিদেশি নাবিককে বন্দরের মোহনার কাছে কর্ণফুলী নদীতীরে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতি সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরতে নগরীর ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
জানা যায়, ইউরি রেডকিনের বর্তমানে সমাধি স্তম্ভটি বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির অধিকৃত। নেভাল একাডেমির অধিকৃত হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে সেখানে যেতে নানা আইনি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের উদ্যোগে লালদিঘীর দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ইউরি রেডকিনের স্মৃতি স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

চসিক প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদ বাংলাধারাকে জানান, ইউরি রেডকিনের সমাধিস্তম্ভটি বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির অধিকৃত এলাকায়। সাধারণ মানুষকে সমাধিটি পরিদর্শন করতে নানা আইনি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার এই নাবিক আমাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ জাতির কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। লালদিঘীর পাড়ে রেডকিনের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ফলে দুই দেশের চিরকালীন বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আরও সমুন্নত হয়েছে।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বাংলাধারাকে জানান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরবর্তী কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ করতে গিয়ে মারা যান রাশিয়ান নাবিক ইউরি রেডকিন। তাঁর স্মৃতি সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরতে নগরের ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
চট্টগ্রামে রুশ কনসাল জেনারেল ওলেগ পেত্রোভিচ বয়কো বাংলাদেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, তরুণ রেডকিন চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করে নতুন জন্ম নেয়া একটি দেশকে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করতে এসেছিলেন। অভিযান চলাকালে মাইন বিস্ফোরণে তাকে জীবন দিতে হয়। তাঁর এ আত্মত্যাগ রাশিয়া ও বাংলাদেশের মানুষ গভীয় শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে আজীবন। তাছাড়া রেডকিনের মতো সাহসী এক বীরের স্মৃতি দুই দেশের সম্পর্ককে আরো গভীর করবে বলে মনে করেন তিনি।

পেছনের কথা
বাংলাদেশ তখন সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, কল-কারখানা সবই বিধ্বস্ত। মোট কথা পুরো দেশই তখন একটা ধ্বংসস্তূপ। ১৯৭১ সালের নয় মাসের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরও। বন্দরের প্রবেশমুখে বসানো ছিল প্রচুর মাইন, চল্লিশটিরও বেশি জলযান পানিতে ডুবে থাকার কারণে বিঘ্ন ঘটছিল জাহাজ চলাচলে। এমনই এক জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করতে সাহায্য কামনা করে। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ।
চুক্তি অনুসারে চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত ও জলপথ পরিষ্কার করে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করতে রিয়ার এডমিরাল এস জুয়েঙ্কোর নেতৃত্বে ৮শ’ নৌ সেনা বাংলাদেশে আসেন। এদের মধ্যে প্রথম দলটি পিআই-৪০ জাহাজে করে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছায় ওই বছরের ২ এপ্রিল। চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে গিয়ে সোভিয়েত নৌ সেনাদের প্রচণ্ড বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয় তখন। এগুলোর মধ্যে ছিল অসম্ভব গরম, প্রচুর আর্দ্রতা, পলিমাটি জমা পানির তলায় একেবারেই দেখতে না পাওয়া, প্রচণ্ড স্রোত ইত্যাদি।

সে সময় অনেক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ মনে করেছিলেন যে চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বছর লেগে যেতে পারে। কিন’ তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে কাজ শুরুর মাত্র তিন মাস পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসেই চালু হয়ে যায় চট্টগ্রাম বন্দর। এদিকে বন্দরকে মাইনমুক্ত করা আর বন্দরের প্রবেশমুখ পরিষ্কার করার কাজ শেষ করতে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তারপরও চট্টগ্রাম বন্দর পুনর্গঠনে সোভিয়েত নৌ সেনারা ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেন।
তাদের এ অভিযান চলাকালে তারা ২৬টি ক্ষতিগ্রস্ত ও ডুবন্ত জলযান উদ্ধার করেন, অপসারণ করেন লাখ টনের উপর বর্জ্য। চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করতে গিয়ে তারা প্রায় ১ হাজার ৯শ’ টন স্ক্র্যাপ উত্তোলন করেন নদীর তলা থেকে, বন্দরের প্রবেশমুখকে মাইনমুক্ত করাসহ প্রায় ১ হাজার ২ বর্গমাইল জলসীমা পরিষ্কার করেন। এই অভিযানে সোভিয়েত নৌ সেনারা ৪৪ জন বাংলাদেশীকে প্রশিক্ষণ দেন যারা পরবর্তীতে দেশের প্রথম পেশাদার ডুবুরি হয়েছিলেন। অভিযান শেষ করে চলে যাওয়ার সময় তারা উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু সাজসরঞ্জাম উপহার হিসেবে দিয়ে যান।
প্রায় ২৭ মাসের কঠিন অভিযান শেষে ১৯৭৪ সালের ১২ জুন ‘খাবারোভস্ক’ জাহাজে করে অধিকাংশ নৌ সেনা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্লাদিভোস্তকের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮শ’ নৌ সেনার দলটির বাকি সদস্যরাও বাংলাদেশ ত্যাগ করেন ২৪ জুন। কিন’ একজন চিরদিনের জন্য রয়ে যান এদেশের মাটিতে। তিনি হলেন ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ পিআই-১৫৬’র সিনিয়র নাবিক ইউরি ভিকতোরোভিচ রেডকিন।
চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার সময় ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই নিহত হন তিনি।

এক নজরে ইউরি রেডকিন
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে তিভির শহরে রেডকিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন কোনো এক বছরের ১৮ ডিসেম্বর। শক্তিশালী মধ্যযুগীয় রাজ্যের সাবেক রাজধানী ও রুশ সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শহর তিভির ১৯৩১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কালিনিন নামেও পরিচিত ছিল। রেডকিনের বাবা রেডকিন ভিক্তর আন্দ্রেভিচ ও মা ভ্যালেন্তিনা ইলিনিচনা একবার তার স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করতে এদেশে আসেন।
ইউরি রেডকিনের মা-বাবার কাছে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর লেখা চিঠি
ইউরি রেডকিনের দুঃখজনক মৃত্যুতে বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে তাঁর মা-বাবার কাছে একটি চিঠি লিখেন সেই সময়। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রশস্ত এক পথের ঠিক শুরুতে তাঁর তরুণ জীবন থেমে গেছে। যাহোক, মানুষের জীবনের মূল্য পরিমাপ করা হয় জীবনের মেয়াদকাল দিয়ে নয়, তার ভাল কাজের মাধ্যমে। সেজন্য, নিঃসন্দেহে আপনাদের ছেলের প্রিয় ও উজ্জ্বল স্মৃতি তার দেশের মানুষ, বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মী ও কর্মকর্তাদের হৃদয়ে চিরদিন জেগে থাকবে। আমি আশা করি এটি এরকম এক বিশাল ক্ষতিতে আপনাদের কষ্ট কিছুটা হলেও কমাবে।
তরুণ রেডকিন জীবন উৎসর্গ করেছেন সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশের জন্য। চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন নিজ জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। মৃদুমন্দ বাতাস তার কবরের উপর দিয়ে বয়ে যায় প্রতিটি মুহুর্তে। আশপাশের গাছগুলো তাকে ছায়া দেয় পরম মমতায়। পতেঙ্গার মোহনায় কর্ণফুলী নদীর পানি যেমনি বঙ্গোপসাগরে মিশে চলেছে প্রতিনিয়ত তেমনি রেডকিনের এই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বাংলাদেশ আর রাশিয়ার দৃঢ় বন্ধনকে দৃঢ়তর করবে আজীবন, অনন্তকাল।
বাংলাধারা/এফএস/টিএম













