৬ নভেম্বর ২০২৫

‘শরণার্থী হয়ে থাকতে আমরা মিয়ানমার যাবো না’

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সেখানকার ‘পরিবেশ-পরিস্থিতি’ দেখে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিদল। শুক্রবার (৫ মে) সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা টেকনাফ জেটি ঘাটে এসে পৌঁছায়।

জেটি ঘাটেই অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন রাখাইন এস্টেট ঘুরে আসা রোহিঙ্গা মো. সেলিম। তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারে পৌঁছার পর তাদের তৈরি করা ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের আমরা জিজ্ঞাসা করলাম এগুলো কাদের জন্য? মিয়ানমার প্রতিনিধিরা উত্তরে বললো, এসব ক্যাম্প আমাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাবাসন করা হলে এসব ক্যাম্পে রাখা হবে।

তিনি আরো বলেন, তখন আমরা তাদের (মিয়ানমার প্রতিনিধিদের) বললাম- আমরা ক্যাম্পে কেন থাকবো? আমরা এ দেশের (মিয়ানমারের) নাগরিক আমরা আমাদের নিজেদের বাড়িঘরে ফেরত যাবো।

সেলিম আরো বলেন, আমরা তাদের (মিয়ানমার প্রতিনিধিদের) আরো বলেছি- আমরাসহ মিয়ানমারের ৩৬ জাতি আছে, ৩৫ জাতি যদি নাগরিক সুবিধা নিয়ে থাকতে পারে, আমরা কেনো নাগরিক সুবিধা পাবো না। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার নাগরিত্বসহ এম্বেসি কার্ড না পেলে মিয়ানমার ফিরে যাবো না।

এর উত্তরে মিয়ানমার প্রতিনিধিরা সেলিমদের নাগরিকত্ব কার্ড সরবরাহ করবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল। আর পূর্ণ নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমার যাওয়া মানে অতিথি হয়ে থাকা। এমনটি হলে তারা যেকোন মূহুর্তে আবার রোহিঙ্গাদের বের করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্য মো. সেলিম।

রাখাইন এস্টেট ও আশপাশ দেখে ফেরা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের কাছে আমরা প্রস্তাব রেখেছিলাম যারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদের জন্য প্রত্যাবাসন পরবর্তী কি অ্যারেঞ্জমেন্ট রয়েছে তা যেন রোহিঙ্গাদের স্ব চক্ষে দেখানো হয়। তারা আমাদের সে প্রস্তাব গ্রহন করেছে এবং তাদের প্রস্তাবে আমরা শুক্রবার (৫ মে) সকালে ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা দল নিয়ে মিয়ানমার মংডু টাউনশীপে যায়। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরিকৃত ঘর গুলো আমাদেরকে ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। আমাদের সাথে দেখেছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও।

আরআরআরসি আরো বলেন, আমাদের মন্দ লাগেনি। সবকিছু গোছানো মনে হয়েছে। তবে, মুলত এগুলো বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্যই, আমরা তো তাদের প্রত্যাবাসনের আয়োজক মাত্র। যারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদেরকে এগুলো দেখানোই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। মিয়ানমার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদলকে এসব বিষয়ে ব্রিফিং করেছে।তারা (রোহিঙ্গারা) কি দেখেছে তারাই বলতে পারবে। পরবর্তী পদক্ষেপ গণমাধ্যমকে অবশ্যই জানানো হবে।

তখন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের বক্তব্য, নাগরিকত্ব ছাড়া সেখানেও আশ্রিত জীবনে তারা যাবে না- এ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আরআরআরসি মিজানুর রহমান বলেন, এটা দীর্ঘ অর্ধশত বছর ধরে চলে আসা সমস্যা। এটাতো আমরা দুই-এক দিনে সমাধান করতে পারবো না। আমরাতো ২০ জনকে সাথে নিয়েছিলাম। একজন কি বলেছে সেটা গণ্য নয়, সবার মতামত আমরা জানবো। আসল কথা হলো আমরা, শুরু করতে চাই। প্রত্যাবাসন আরম্ভ করতে হলে, দুই পক্ষকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে।

এর আগে, শুক্রবার (৫ মে) সকাল সাড়ে ৯টায় টেকনাফের নাফনদের জেটি ঘাট হয়ে প্রতিনিধিদলটি মিয়ানমারের মংডু শহরের উদ্দেশ্যে টেকনাফ ত্যাগ করেন বলে জানান টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।

প্রতিনিধিদলে ২০ জন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতার সাথে বাংলাদেশ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের ৬ কর্মকর্তা এবং একজন দোভাষী
ছিলেন। ২৭ জনের প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমারের রাখাইন এস্টেটের মংডু টাউনশিপের আইডিপি ক্যাম্পের পরিস্থিতি দেখার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে আবারও টেকনাফ জেটিঘাটে ফিরে আসে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাখাইনে যেতে তালিকায় থাকা ২০ রোহিঙ্গাকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টেকনাফস্হ নাইটংপাড়া বিআইডব্লিউটিএ ‘নন্দী নিবাস’ রেস্ট হাউজে রাত্রি যাপনের নিয়ে আসা হয়।

মিয়ানমারে যাওয়া ২৭ সদস্যের মাঝে ৩ নারীসহ ২০ জন রোহিঙ্গা, একজন অনুবাদক ও ৬ জন বিভিন্ন দপ্তরের বাংলাদেশি কর্মকর্তা ছিলেন। নিরাপত্তার জন্য বিজিবির ২টি স্পিডবোটসহ ১৬ জন বিজিবি সদস্যও যান।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র মতে, ইতিপূর্বে মিয়ানমারের টেকনিক্যাল টিম কর্তৃক যাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ সম্পন্ন হওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৪ থেকে দুইজন, ২৬ থেকে চারজন, ২৭ থেকে ১৪জনসহ মোট ২০ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমার গেছেন। তাদের সাথে আরআরআরসি (যুগ্ম সচিব) মো. মিজানুর রহমান নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি মিলিয়ে ৭ জন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাও রয়েছেন। ২৭ জনের এ প্রতিনিধিদল মংডুর আইডিপি ক্যাম্পসহ ১৫টি গ্রামের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

এর আগে ১৫ মার্চ টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমার সরকারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তারা বাংলাদেশে আশ্রিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের দেয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা যাছাই-বাছাই করেন।

প্রতিনিধিদলটি টানা সাতদিন টেকনাফের স্থলবন্দর রেস্ট হাউজে অবস্থান করে বাংলাদেশে আশ্রিত ১৪৭ রোহিঙ্গা পরিবারের মোট ৪৮৬ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। আর তাদের দেওয়া বক্তব্য রেকর্ড করেন। ২২ মার্চ সকালে প্রতিনিধিদলটি নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যায়।

ওই সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যাদের প্রত্যাবাসন করা হবে সেই সব রোহিঙ্গা যাতে আগে থেকে রাখাইনের সার্বিক পরিবেশ স্বচক্ষে দেখে আসতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল শুত্রবার রাখাইন যান।

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার পর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে প্রত্যাবাসনের জন্য ৮ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছিল। সে তালিকা যাছাই-বাছাই করে মাত্র ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল মিয়ানমার।

এর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘ সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই হত্যা ও নির্যাতনকে চিহ্নিত করেছিল ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

এরপর আসে করোনাভাইরাস মহামারি, রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সঙ্কটের মধ্যেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং।

সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকারে রাখা বাংলাদেশ সরকার বারবার অভিযোগ করে আসছে, আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক হয়।

এরপর গত বছরের ১৪ জুনে হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, মিয়ানমারের তা যাচাই করে দেখার কথা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনও আঁতুড় ঘরেই রয়েছে।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ