সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
চলতে শরৎকাল, ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে শুষ্ক মৌসুম। সাগরে উত্তালতা না কমতেই রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে সাগরপথে মানবপাচার শুরু করেছে একটি দালালচক্র। দালালচক্রের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বিগত অর্ধযুগে সাগরে ডুবে মারা গেছেন অসংখ্য বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিক। সেই যাত্রায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। বিষয়টি প্রখরভাবে আলোচনায় এলে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও অভিযানের ফলে মানবপাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
তবে, এবার শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই সম্প্রতি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। শীত মৌসুমে সাগর প্রায় শান্ত থাকায় মানবপাচার বাড়ে। পূর্বের মতো এবারও পাচারকারিদের টার্গেট প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সাথে উন্নত জীবনের আশায় যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশি বেকার পুরুষরাও।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার পথে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার অদূরে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে রোহিঙ্গা তিন কিশোরী ও এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ-কোস্টগার্ড। এ ঘটনায় মোট ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক নুর মোহাম্মদ।
তিনি জানান, সাগর পথে মালয়েশিয়া যাবার পথে রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনায় টেকনাফের বাহারছড়ার শীলখালী এলাকা থেকে তিন কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পৃথক ভাবে ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের মাঝে ৮জন নারী। উদ্ধার হওয়াদের মাঝে ৪ জন বাংলাদেশি এবং বাকি সবাই বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা। মরদেহসহ জীবিতদের তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদ্ধারদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। দালাল ও তাদের সহযোগীদের সনাক্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এছাড়াও গত ২০ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) রাত ৯টায় টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী দলের আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য জড়ো করা ১৫ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। টেকনাফ পৌরসভা নাইট্যংপাড়া মৃত নজির আহমদের ছেলে জামাল হোসেনের (৫৫) বাড়িতে এ ১৫ বাংলাদেশিকে জড়ো করা হয়েছিল বলে জানান টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার।
উদ্ধার বাংলাদেশিরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায়, মানবপাচারকারী জামাল হোসেন ও টেকনাফ পৌরসভার নাইট্যংপাড়া এলাকার মৃত সৈয়দ হোসেনের ছেলে মো. ইউসুফ (৩০), একই এলাকার সৈয়দুল ইসলামের ছেলে কবির হোসেন (২৫), নজির আহমেদের ছেলে মো. ইলিয়াস (৩০) ও হোসেন আহমদের ছেলে ইব্রাহিম (৪০) তাদের মালয়েশিয়া পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় মানবপাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির থেকে কৌশলে পালিয়ে দালালের হাত ধরে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এভাবে গত মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) ও ২০ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টার সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন ৬০ জন। এদের মাঝে ২০ জন বাংলাদেশি, বাকিরা রোহিঙ্গা। চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবার ১৫ জনকে মানবপাচারকারী চক্রের হাত হতে উদ্ধার করে পুলিশ-বিজিবি। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে দালাল চক্র মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে দু’দিন ধরে সাগরে এদিক-ওদিক ঘোরানোর পর ‘থাইল্যান্ডের তীরে পৌঁছেছি’ বলে টেকনাফের সৈকতে ১৪ রোহিঙ্গাকে নামিয়ে দেয়। পরে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে। একই বছর ৭ নভেম্বর একইভাবে আরও ৩৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এসময় ছয় দালালকেও আটক করা হয়। তারা আবার স্থানীয়।
আইন-শৃখলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টায় গত বছরের ৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দফায় কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫৪৯ জন রোহিঙ্গা ও ২১ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে বেশিরভাগই নারী। তবে, মঙ্গরবার উদ্ধার হওয়াদের মাঝে নিহত তিনজনসহ ১১ জন নারী।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পুরিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলা হওয়ায় কক্সবাজারে মানবপাচারের ঘটনা বেশি। এছাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রের কারণে মানবপাচারের ঘটনা প্রতি শুষ্ক মৌসুমে বেড়ে যায়। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকায় ধরাও পড়ছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে কক্সবাজার জেলা পুলিশ মানবপাচারকারীদের একটি তালিকাও করেছিল। সেটি মডিফাই করার কাজ চলমান রয়েছে। মডিফাই তালিকা ধরে অভিযান জোরদার করা হবে।
আদালত সূত্রমতে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের চলতি সময় পর্যন্ত মানবপাচারের ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এছাড়াও প্রায় মানবপাচারের মামলা আসছে আদালতে।
জানা গেছে, প্রথমদিকে টেকনাফ-মিয়ানমার আন্তঃসীমান্তে মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় থাকলেও পরে কক্সবাজার জেলা পেরিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকার শহরতলী হয়ে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত নেটওয়ার্ক বিস্তার করে। এই নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব দেয় মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে এসে বসতি গড়া রোহিঙ্গারা। পরে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি এই নেটওয়ার্কটি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা অপহরণের পর বিদেশে পাচার করে মুক্তিপণ আদায়, থাইল্যান্ডে দাস শ্রমিক হিসেবে বিক্রি, এমনকি খুনও করে থাকে। এই চক্রের খপ্পরে পড়ে শত শত যুবক নিখোঁজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রামে চলছে এখনও কান্নার রোল।
জীবন বদলের স্বপ্নে দালালের মাধ্যমে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাবার ইচ্ছে নিয়ে থাইল্যান্ডে দাসখানায় মারা যায় কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়ার শুক্কুর আহমদ ড্রাইভারের ২৩ বছর বয়সী ছেলে পুতিয়া। তারই মতো মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে একই ইউনিয়নের সেগুনবাগিচা এলাকার শাহ আলমের মেয়ে জামাই আবুল হাশেমসহ খুটাখালী গ্রামের মাত্র একটি ওয়ার্ডের (৬ নং ওয়ার্ড) ১৪ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। খোঁজ মেলেনি হাশেম ড্রাইভারের ছেলে হামিদুল হকের, ইসলাম নুরের ছেলে রবিউল হাসানের, সুলতানের ছেলে জিয়াউর রহমানের, মোহাম্মদ ইসলামের ছেলে মনুর আলমের, বদরার ছেলে আনোয়ারের, লোকমান হাকিমের ছেলে মিজানের, অহিদুল আলম ধেছুর ছেলে ইউনুছের, সোলেমানের ছেলে কালুর, ইউসুফ আলী ছেলে আনোয়ারের, সুলতানের ছেলে নুর মোস্তফার, অলি আহমদের ছেলে কাদুরার, বাদশা মিয়ার ছেলে ফারুকের, ঈদগাঁওর কলেজ গেইট এলাকার বেলাল উদ্দিন অকিয়া, বদিউল আলমের ছেলে নাছির উদ্দীনের। এদেরই মতো কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামের শত শত মালয়েশিয়াগামী যুবকের কোনো খোঁজ নেই দীর্ঘদিনেও। এসব ঘটনায় আসলে কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যানও সরকারি-বেসরকারি কোনো দপ্তরে নেই।

ওই সময় মালয়েশিয়াগামী অনেক মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে মারা যায়। অনেকেই সমুদ্রে দালালচক্রের গুলিতে মারা যায় বলে মুক্তিপণে ফিরে আসা অনেকে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, মূলত রোহিঙ্গা দালালেরাই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের এ রুটটি আবিষ্কার করে। অসচ্ছল ও বেকার যুবকদের জীবন বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নগদ ১০ থেকে ২০ হাজার ও দেড়-দুই লাখ টাকা বাকিতে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার শর্তে সহজেই ফাঁদে ফেলছে; বিশেষ করে যুবকদের। মালয়েশিয়া যাবার জন্য চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্ন সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে ছোট নৌকাযোগে উপকূল থেকে সমুদ্রে বড় জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। সেই ট্রলারে ১০ দিন পর থাইল্যান্ড পৌঁছে দেয়। থাইল্যান্ডে অবস্থানের সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করা হয়। মুক্তিপণ পেলে মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বিভিন্ন খামারে শ্রমিক হিসাবে পাঠানো হয়। কারো মুক্তিপণ পাওয়া না গেলে তাদেরকে থাইল্যান্ডে দাস শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অথবা দিনের পর দিন সেখানে নির্যাতন চালানো হয়। এমন নির্যাতনে মারাও গেছেন অনেকেই। কিন্তু স্থানীয়রা আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে না পারলেও এখন রোহিঙ্গারা সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছে মানবপাচারকারীদের। মিয়ানমারে জোর করে ফিরিয়ে দেয়া হবে, সেখানে গেলে মগেরা কেটে ফেলবে, বিশেষ করে নারীরা মালয়েশিয়া গেলে ভালো বরের সঙ্গে বিয়ে হবে, যুবকদের ভালো চাকরি হবে এমন বিভিন্ন ভয় ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে মানবপাচারকারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের কয়েকজন মাঝি (নেতা) জানান, যাদের আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়ায় বাস করছে, এ ধরনের রোহিঙ্গারাই মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। তারা হুণ্ডির মাধ্যমে দালালদের কাছে টাকা পাঠায়। আবার যাদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে নেই তারাও উন্নত জীবনের আশায়, অবিবাহিত নারীরা বিয়ের প্রলোভনে মালয়েশিয়া চলে যেতে চায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া ত্রাণ সামগ্রী বিক্রি করে টাকা জমিয়ে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে।
তাদের মতে, সড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক চেকপোস্ট থাকলেও দালালের হাত ধরে রাতের আঁধারে পাহাড়ি পথে রোহিঙ্গারা পাচারের শিকার হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আসা ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকগুলো চেকপোস্ট কাজ করছে। এরপরও। বিভিন্ন পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে বলে জেনেছি।













