২৮ অক্টোবর ২০২৫

শৃঙ্খলা ফিরছে কক্সবাজার জেলা কারাগারে, স্বস্তিতে বন্দিরা

জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার »

অনিয়মে সমালোচিত কক্সবাজার জেলা কারাগারে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা ফিরছে। গত তিন মাসে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া বন্দিরা। দর্শনার্থী ঘরে উন্নতমানের সিলিং, বিনোদনের জন্য বড় টেলিভিশন ও সচল হয়েছে ক্যান্টিন। পরিপাটি করে সাজানো কারা ফটকের উপরে ডিজিটাল প্লে-বোর্ড বসিয়ে জামিন প্রাপ্ত বন্দিদের নাম প্রচার করা হচ্ছে। এতে কোন বন্দি জামিনে বের হবেন সেটা প্রধান সড়ক থেকে অনায়াসে পড়ে নেয়া যাচ্ছে। তবে, এখনো কয়েকজন ‘রাক্ষুসে’ কারারক্ষী কর্তৃপক্ষের অগোচরে বিকাশ প্রতারণা সচল রেখেছে। বন্দিদের সঙ্গে তারা খারাপ আচরণও অব্যহত রেখেছেন বলেও দাবি করেন তারা।

আদালত থেকে জামিনের পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে টেকনাফের বাসিন্দা ওমর আলী, আবু সিদ্দিক, মো. গোলামুর রহমান ও আবুল কাসেমসহ কয়েকজন জানান, কারাগারে গত তিন মাসে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে। নতুন জেল সুপারের (শাহ আলম খান) তদারকির কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির লাগামে টান পড়েছে। পাশাপাশি কারাগারে খাবারের মানও বেড়েছে বলে দাবি তাদের।

দীর্ঘদিন কারাভোগের পর সদ্য মুক্তি পাওয়া সদরের ঝিলংজা লারপাড়ার বাসিন্দা নুরুল আলম ও শাহদাত জানান, কক্সবাজার কারাগারে দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জামিন হওয়া বন্দিদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করা হতো। কেউ টাকা দিতে অপারগ হলে বিভিন্ন অজুহাতে রেখে দেয়া হতো আরও কয়েকদিন, এমন ঘটনা ছিল অহরহ। মোটা অংকের বিনিময়ে কারাগারে বসে সরকারি মোবাইল ব্যবহার করেছিল প্রভাবশালী মাদক কারবারিরা। কারাগারে বসে যেন তারা ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে পারে, সেই সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

জেল ফেরত ওমর আলী ও আবু সিদ্দিক জানান, তিনমাস আগে বিত্তশালী ও ইয়াবা কারবারি ছাড়া সরকারি মোবাইলে সাধারণ বন্দিরা তেমন সুযোগ পেতেন না। মিনিটে ২০ টাকা হিসেবে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন মাদক কারবারিরা। কিন্তু বর্তমানে নিয়ম অনুয়ায়ী প্রতি সপ্তাহে সাধারণ বন্দিরা ১০ মিনিট করে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়াও অযথা হয়রানি ও সিট বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি খাবারের মান বেড়েছে।

তবে, রাক্ষুসে কয়েকজন কারারক্ষীসহ একটি চক্র বিকাশে টাকা হাতাচ্ছেন। চক্রটি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে হাত করে সাধারণ বন্দিদের এখনও হয়রানির চেষ্টা করছে বলে দাবি করেন কারামুক্ত বন্দিরা। এমন কি মাদক কারবারিদের ইচ্ছে মতো মোবাইল ব্যবহারে সুযোগ বন্ধ হওয়ায় জেল সুপারসহ কয়েকজনকে পরিবর্তন করে পছন্দের কর্মকর্তাকে আনার চেষ্টা করছে বলে দাবি তাদের।

কক্সবাজার কারাগারের বন্দি সদরের জিয়াউল হকের স্ত্রী রাহেলা আকতার বলেন, আমার স্বামী পাঁচমাস ধরে কারান্তরিণ। মাসে একবার করে তাকে দেখতে যাই। সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গরমের কারণে দর্শনার্থী ঘরে বসা যেত না। কিন্তু এ মাসে গিয়ে দেখেছি ভিন্ন চিত্র। দর্শনার্থী ঘরে উন্নতমানের সিলিং, দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য বড় টেলিভিশন ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেখার সিরিয়াল আসতে আগে বিরক্ত লাগলেও এখন রিলাক্সে অপেক্ষা করা যায়।

সরেজমিন দেখা যায়, পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে কারাগার এলাকা। কারা ফটকের উপরে ডিজিটাল প্লে-বোর্ড বসিয়ে জামিনের কাগজ কারাগারে আসা মুক্তির অপেক্ষায় থাকা বন্দিদের নাম প্রচার করা হচ্ছে। এতে কোন কোন বন্দি জামিনে বের হবেন সেটা প্রধান সড়ক থেকে অনায়াসে পড়ে নেয়া যাচ্ছে।

কারাগার সূত্র জানায়, লাগামহীন দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশের পর সমালোচনার মুখে গত ২৯ জুলাই কক্সবাজার কারাগার থেকে তৎকালীন জেল সুপার নেছার আহমেদকে বদলী করা হয়। এরপর এক জুলাই জেল সুপার হিসেবে যোগদান করে শাহ আলম খান।

জেল সুপার শাহ আলম খান বলেন, যেহেতু কারাগারে বিশৃঙ্খলা নিয়ে সমালোচনা ছিল সেহেতু আমি যোগদানের পর প্রথমে নজর দিয়েছি শিঙ্খলা ফেরানোর কাজে। বন্দিদের স্বজনের দেখা সাক্ষাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও দর্শণার্থীদের সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাল ব্যবহার নিশ্চিত তদারক করা হচ্ছে। বন্দিদের বিনোদনে ভেতরে উন্মুক্ত স্থানে এলইডি বড় মনিটর সংযোজন করে নাটক, গান ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। সেখানে প্রতিদিন বিকালে এক ঘন্টা করে মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দিদের সব কাজে নিশ্চিত করা হচ্ছে স্বচ্চতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন।

জেল সুপার আরও বলেন, প্রতিদিন সরকারী মোবাইল বুথে বন্দিদের সিরিয়ালে কথা বলা নিশ্চিত হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে কারাভ্যন্তরে নগদ টাকা ব্যবহার। কারা ক্যান্টিনে নির্ধারিত মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে পিসির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে কারাক্যান্টিন থেকে মালামাল ক্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। কারা ক্যান্টিনে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কারারক্ষী বাছাই ও নিয়োজিত করায় শতভাগ সচ্ছতা এসেছে। খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়মিত তদারক এবং পরীক্ষার পর বন্দীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। বন্দিদের সিট বণ্টন, আবাসন ব্যবস্থায় হয়রানী বা অর্থের লেনদেনও বন্ধ।

আরও পড়ুন