৯ ডিসেম্বর ২০২৫

সংকটের তিন বছরে বেড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-কেন্দ্রিক অপরাধ

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »

মিয়ানমারের রাখাইনে সরকার ও বৌদ্ধ যুবকদের কাছে নিপীড়নে প্রাণ রক্ষায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার তিন বছর অতিক্রম হলো ২৫ আগস্ট। সংকটের এ তিন বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এবং আশপাশ এলাকা অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। গত তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরণের অপরাধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামী হয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা।

তবে গত বছরের চেয়ে চলতি বছরই অপরাধের ব্যাপ্তি কিছুটা কম বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন। মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা কারাগারে ৫৫২ পুরুষ ও ৪৮ নারী রোহিঙ্গা বন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন জানান, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, ফরেনার্স এ্যাক্ট, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ও অন্যান্য অপরাধ এ ১২ ক্যাটাগরিতে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামী হয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। যার মাঝে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উল্লেখযোগ্য।

২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামী হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামী হয়েছে ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩ আর আসামী হন ৬৪৯ জন। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা নানা অপরাধীদের বিরুদ্ধে হওয়া ১৮৪ মামলায় আসামী হয়েছে ৪৪৯ জন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা চালান এনে ক্যাম্পে মজুত রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির মাঝেও ক্যাম্পে ইয়াবা চালান, মজুত এবং লেনদেন করা নিরাপদ।

কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় অপরাধীরা সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু সেখানে যখন তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে। এ সুযোগে ক্যাম্পে ঘটছে অপরাধমূলক কর্মকান্ড। এছাড়া অধিকাংশ ক্যাম্প পাহাড় সংলগ্ন হওয়ায় কয়েকটি ডাকাত দলের অপরাধও বেড়েছে। ফলে ক্যাম্প অপরাধীদের জন্য নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা মজুত ও লেনদেনের জন্য ক্যাম্পগুলো ব্যবহার করছে অপরাধীরা।

কক্সবাজারের ৩৪ ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধ দমনে চলতি বছরের জুলাই থেকে দায়িত্ব পালন করছে ১৪ ও ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর সদস্যরা। এর আগে সেখানে জেলা পুলিশ দায়িত্বে ছিল। জুলাইয়ে টেকনাফে ১৬ এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা মাদক ও অস্ত্রসহ ১৬ রোহিঙ্গাকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ইয়াবা, ৩টি অস্ত্র ও ৩০ লিটার মদ উদ্ধার করে তারা।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কোনও না কোনও ক্যাম্প থেকে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের খবর পাওয়া যায়। তবে ক্যাম্পে অপরাধপ্রবণতা বাড়লেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন।

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড় ঘিরে ৪-৫টি সংঘবদ্ধ ডাকাত বাহিনী সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে ডাকাত জকির আহমদ ওরফে জকির ও আবদুল হাকিম বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। বেশিরভাগই ডাকাত জকির ও হাকিম বাহিনী টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়, হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, মিনাবাজার, পুটিবনিয়া, লেদা, জাদিমুরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে আনাগোনা রয়েছে। তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে পাহাড় ও ক্যাম্পে মজুত করে। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করছে। এছাড়া পাহাড়ে আশ্রয়স্থল বানিয়ে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় অব্যাহত রেখেছে ডাকাতদলগুলো।

বিজিবি বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পসহ বিভিন্ন সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৪০ পিস ইয়াবাসহ ১৩২ জনকে আটক করা হয়। এছাড়া ইয়াবা পাচার ও মজুতকালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১৩ রোহিঙ্গা।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. ফয়সল হাসান খান বলেন, সীমান্তে বিজিবি তৎপরতার কারণে ইয়াবা পাচার কিছুটা কমেছে। তবে রোহিঙ্গাদের কারণে ইয়াবা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন ক্যাম্পে মাদক কারবার বেড়েছে। কারণ মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য ক্যাম্প এখন নিরাপদ স্থান। তবে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অর্জনে বিজিবির টহল অব্যাহত রয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র মতে, কক্সবাজারের চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৬৮ জন নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ৫১ জন রোহিঙ্গা ছিল। তাদের মধ্যে ২৬ জন ছিল সক্রিয় ডাকাত। বাকিরা মাদক কারবারি।

গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের কারণে অন্তত ৪৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা নিহত হন।

কুতুপালং ক্যাম্প মাঝি মোহাম্দ ইসমাইল ও টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা জাফর আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি ক্ষৃদ্র্র অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা বিব্রত। কিন্তু যারা মাদক পাচারসহ নানা অপরাধ করছে, তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকজনও জড়িত। যেসব রোহিঙ্গা এসব অপরাধ করছে তারা ক্যাম্পে থাকে না। তবে এটা সত্যি, অপরাধ করার পর অনেকে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের হামলায় স্থানীয়ও নিহত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছে তাদের হামলায়। এদের এখনই দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন স্থানীয়রা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েছে স্বীকার করে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, চলতি বছরে ২০ জানুয়ারি থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে ১৫ লাখ ইয়াবা ও দুই শতাধিক মাদক সংশ্লিষ্টকে আটক করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু ক্যাম্প থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৪২ ইয়াবাসহ ৬৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঠেকাতে র‌্যাবের ভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, সবকিছু শতভাগ নির্মূল সম্ভব হয় না। কিন্তু অপরাধের লাগাম ধরে রাখা সম্ভব। আমরা সেই পথে অবিরাম চলছি। রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সদা সচেষ্ট রয়েছে শৃংখলা বাহিনী।

বাংলাধারা/এফএস/টিএম/এএ

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ