মুহাম্মদ আব্দুল আলী »
একজন শিল্পী তাঁর চারপাশের পরিবেশ গভীরভাবে অবলোকন করেন। সুন্দরের দৃষ্টিতে দেখেন তাঁর আশপাশের পরিবেশকে। সৃষ্টি করেন শিল্প। তিনি সৃষ্টির লক্ষ্যে কোন কাজে অবহেলা করেন না। তিনি চান শুধু মানুষের কল্যাণ, শৈল্পিক-সুন্দর জীবন। আর এ জীবনকে তাঁর ক্যানভাসে তুলির আচঁড়ে ফুটিয়ে তুলেন। তখন তিনি হয়ে উঠেন একজন মহৎ শিল্পী। আর এ মহৎ শিল্পী হতে হলে শিল্প সৃষ্টিতে সফল হতে হয়। একজন রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রেও কিন্তু একই। একজন রাজনীতিবিদও রাজনৈতিকশিল্পী হতে পারেন। যদি তিনি তার আশপাশের মানুষের সংস্কৃতি, ধর্ম-কর্মসহ সেই জগণের মনের কথা, ব্যাথা ও হালচাল গভীরভাবে অবলোকন করে তাদেরকে নিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারেন এবং তাদের মন জয় করতে পারেন তবে তিনিই একমাত্র মহৎ রাজনৈতিকশিল্পী। আর রাজনীতি সোসাইটিতে এমন একজন শিল্পীকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তিনি হলেন চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দীন চৗধুরী।
নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের কাছে তিনি প্রিয় ‘মহিউদ্দিন ভাই’, সাধারণ মানুষের কাছে ‘মেয়র সাব’, বিপ্লবীদের চোখে তিনি ‘বাঘা মহিউদ্দীন’, নগরীরর উন্নয়ন ও পরিকল্পনার জন্য তিনি ‘চট্টগ্রামের মাহাথির মোহাম্মদ’ হিসেবেও পরিচিত। এসব অভিধা থেকে তাঁর কর্মেও পরিধি ও মানুষের অন্তরে তাঁর ব্যাপ্তির গভীরতা উপলব্দ হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভেতরে মহিউদ্দীন চৌধুরীর জন্ম।
শিল্পকে যেমন গণমানসিকতা এবং কালমানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, অনুরূপ রাজনৈতিক শিল্পীদেরও এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে তাদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। আর চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এই দুটো বিষয়ের ক্ষেত্রে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন।
তিনি চট্টগ্রামের মানুষের অধিকার, সংস্কৃতি, ধর্ম ও কৃষ্টি-কালচার সবই বুঝতে চেষ্টা করেছেন এবং যে কোন সমস্যায় সমাধান করেই ছেড়েছেন। মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো কারো সাথে আপস করেননি। যে কারণে তাঁর প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের এতো ভালোবাসা। যে ভালোবাসা এখনো আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রতি চট্টগ্রামবাসীর আস্থা। মানুষ তাঁকে চিরকালই মনে রাখবে। তাই তিনি রাজনৈতিকশিল্পী। শুধু শিল্পীই নন সফল একজন মহৎ রাজনৈতিকশিল্পী।
ইতিহাসে নেতা হিসেবে তিনিই স্মরণীয় যিনি তার কালকে অতিক্রম করে ভবিষ্যৎ দেখতে পান এবং জনগণকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সেই অভিমুখে ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তনের সামর্থ্য রাখেন। আমাদের ইতিহাসে তমনই সময়ের কষ্ঠিপাথরে যাচাই করা এক কালোত্তীর্ণ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
আমি হয়ত এ রাজনৈতিকশিল্পীর সাথে কখনো কথা বলতে পারিনি, দেখাও হয়নি ওভাবে। তবে বিভিন্ন সমাবেশ, সভায় বক্তব্য শুনেছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কারণ তাঁর সম্পর্কে সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। এ পরিণত বয়সে তাঁকে অন্তত পক্ষে সমাবেশে দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। কিশোরকাল থেকেই এ চট্টলবীরের কথা শুনে আসছি গুরুজনদের কাছ থেকে। তখনে থেকেই অজান্তে তাঁর প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে আমার হৃদয়ে। এ পরিণত বয়েছে এসে এ ভালোবাসা আরও বেড়ে গেলো।
চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক কৌশল আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হয়। যে কোন রাজনীতিবিদ তার নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ থাকে, থাকে দলের কিছু সীমাবদ্ধতা। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরীর বেলা তা ছিল একেবারে ভিন্ন। তিনি দল-মত সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষকে স্থান দিয়েছেন, মানুষের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম চিন্তা করেছেন তাঁর আশপাশের মানুষের কথা। কখন পার্টি কি করবে সেদিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন নি বরং তিনি যেকোনভাবে সামাধান করতে চেষ্টা করেছেন।
একজন সত্যিকারে রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি কর্ম ও ভালবাসা দিয়ে রাজনীতির তৃণমূল পর্যায়কে আলিঙ্গন করেছিলেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। তাঁর শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় ছিল রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা। টানা সতের বছর নগরপিতার আসনে আসিন ছিলেন। যেখানে অনিয়ম-অনাচার লক্ষ্য করেছেন সেখানেই তিনি দাঁড়িয়ে গেছেন এবং রুখে দিয়েছেন সকল ষড়যন্ত্র। তাইতো তিনি চট্টলবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
শিল্প হচ্ছে অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি সহজাত কর্মকাণ্ড। কিন্তু অধুনা রাজনৈতিক শিল্পে এ অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে অসৎ উপায়কে অবলম্বন করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা কেবল ব্যক্তি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকছে। কথায় আছে, মানুষ কেবল রুটিতেই বাঁচবে না। এই যে রুটি অর্জনের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু করতে চায় মানুষ, সেটাই শিল্প। আর মহিউদ্দিন চৌধুরী ওই রুটি ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন চট্টলাবাসীকে।
কবি কীটসের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি— সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য। তাই শিল্পের বৈশিষ্ট্য শুধু সুন্দরকে রূপদান করা নয়, সত্যকে প্রকাশ করাও। সত্যের ব্যাপ্তি কেবল সুন্দরে সীমাবদ্ধ না থেকে অসুন্দরের মাঝেও অবাধ প্রবেশ করে। শিল্পের কী অদ্ভুত গুণ যে, বাস্তবে যে ব্যক্তি বা বস্তুকে দর্শনেই আমরা ঘৃণা করি, শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে সেই ব্যক্তি বা বস্তুকে অপরূপ করে ফুটিয়ে তোলেন।
অনেক শিল্পীর কাছে জীবন সায়াহ্নে তারা ধরা দেন শুধুই প্রহেলিকা-মরীচিকার অনুলিপি বা প্রতিলিপি রূপে। পক্ষান্তরে এ কথাও সত্যি যে, প্রায় দুই লাখ ত্রিশ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত চাঁদ একটা মৃত তারকা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু সেই চাঁদই শিল্পরসিকের ভাষায়— ‘চন্দ্র আঁধার রাতের রাণী’ অর্থাৎ জড়কে প্রাণ দেয়া যেমন শিল্প প্রতিভার ধর্ম, ঠিক তেমনি মহিউদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুর পরও চট্টগ্রামবাসীকে প্রাণ দিয়ে যান, শক্তি ও সাহস যোগান।
আমাদের সবার জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তই রাজনীতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ এই রাজনীতিকে নিয়েই আমাদের সমাজে রয়েছে নানা নেতিবাচক গুঞ্জন। অনেকেরই ভাষ্যমতে, রাজনীতি একটি খারাপ দিক। এটি খারাপ মানুষেরা করে থাকেন। কোনো ভালো মানুষ নয়, এখানে অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এটি একেবারেই ভুল ধারণা। যে ভুল ধারণা ভেঙে দেয় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন।
সমাজ পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গিই হলো রাজনীতি। সমাজের শোষক ও শোষিত এ দুটি ভাগের মধ্যে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী আজীবন লড়েছেন শোষিতের পক্ষে, ছিলেন শ্রমজীবীর পক্ষে। আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে, এমনকি স্বাধীনতার পরেও বেশ কিছুদিন রাজনীতি একটি মহৎ কাজ হিসাবে বিবেচিত ছিল। রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সমাজের চোখে শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু এখন তার উল্টোটাই ঘটেছে কিছু রাজনীতিতে কিছু অপসংস্কৃতি প্রবেশ করার কারণে। এখন রাজনীতি মানে মারামারি, হানাহানি, ভাগবাটোয়া এসব। তাই বর্তমান মেধাবী ছাত্ররা এ ছাত্ররাজনীতি সড়ে দাঁড়িয়েছে। যদি অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ করতে হয় তবে চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো আদর্শবান রাজনীতিবিদদের জীবন অনুসরণীয়।
চট্টগ্রামের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক অঙ্গনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী একটি আদর্শিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নাম। মহিউদ্দিন চৌধুরী জীবদ্দশায় রাজনৈতিক মত প্রকাশের শৈলী, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সংস্কৃতির চর্চা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনগুলো ছিল রাজনীতিবিদদের কাছে অনুকরণীয়, অনুসরণীয়।
মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনৈতিক, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনকে এমনভাবে পরিচালনা করেছিলেন, যা অনেকের কাছে অকল্পনীয় মনে হলেও তেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসুক— চট্টলাবাসী এমনটিই আশা করেন।
আাজ বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। এ বিজয়ের ডিসেম্বর মাসেই তাঁর জন্ম এবং এ মাসেই তাঁর মৃত্যু। এ মাসটি বাঙালি জাতির জীবনে বহুল তাৎপর্যবহ। এ মাসেই বাঙালি জাতি স্বাদ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের। মহিউদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন লড়াকু এক মুক্তিযোদ্ধা। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেননি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছেন। শৈশব ও কৈশোরকাল পরবর্তী যৌবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। পরে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন রাজনীতির মূল ধারার দীর্ঘ পথ। সক্ষম হয়েছেন চট্টলবাসীর হৃদয়মন জয় করতে। এ মহৎ রাজনৈতিকশিল্পীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সহ-সম্পাদক, বাংলাধারা ডটকম