৩০ অক্টোবর ২০২৫

সড়ক দুর্ঘটনা যেন জাতির স্থায়ী অভিশাপ : কাদের গনি চৌধুরী

রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও যৌথ উদ্যোগেই কমবে প্রাণহানি

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, “সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতির জন্য এক স্থায়ী অভিশাপে পরিণত হয়েছে।” তিনি বলেন, প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বা পঙ্গুত্বের খবর। এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, গোটা সমাজ ও অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আয়োজিত “সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সকল মতপক্ষের রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা জরুরি” শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন নিসচার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লিটন এরশাদ। এতে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া, ডিআরইউ’র সাবেক সভাপতি মোরসালিন নোমানী, সিনিয়র সাংবাদিক শাহাবুদ্দিন শিকদার, নিসচার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (ভার্চুয়ালি) মিরাজুল মইন জয়, মহাসচিব এস.এম. আজাদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহমান ও সদস্য মান্নান ফিরোজ।

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজার ৩৮০ জন, তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৪৪৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৭ জন, আহত ৬৮২ জন।

ওয়ার্ল্ড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের সরকারি বিধান থাকলেও অনেকেই তা জানেন না। আইন অনুযায়ী নিহতদের পরিবার ৫ লাখ, অঙ্গহানিতে ৩ লাখ এবং গুরুতর আহতদের সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা সহায়তা পাওয়ার কথা। কিন্তু ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয় বলে অনেকে তা করতে পারেন না। এজন্য তিনি আবেদনের সময়সীমা ৯০ দিন করার আহ্বান জানান।

বিএফইউজের মহাসচিব বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এখনো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নসিমন-করিমনসহ ফিটনেসবিহীন যানবাহন মহাসড়কে চলছে। এদের হঠাৎ রাস্তা পারাপারের কারণেই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।”

তিনি বলেন, বিআরটিএ’র হিসাবে দেশে ছয় লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যা আরও বেশি। উৎসবের সময় পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ গাড়িগুলো রাস্তায় নামানো হয়, আর টিপভিত্তিক আয়ের কারণে চালকেরা বিশ্রাম ছাড়াই গাড়ি চালান ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

কাদের গনি চৌধুরী আরও বলেন, “বাংলাদেশে পরিবহন খাতকে এখনো শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে চালকদের কর্মঘণ্টা, বেতন ও নিয়োগপত্রের নিয়ম নেই। এটি সড়ক নিরাপত্তার বড় বাধা।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার, পরিবহন মালিক, চালক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ, রোড ডিভাইডার স্থাপন, রাস্তা সংস্কার, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি এই পদক্ষেপগুলো এখনই নিতে হবে।”

বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। জানি ঝুঁকি আছে, তবুও আমরা হাইওয়েতে ভটভটি বা ব্যাটারিচালিত গাড়িতে উঠি। এই মানসিকতা না বদলালে কোনো আইনই কার্যকর হবে না।”

আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে নিসচার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিরাজুল মইন জয় বলেন, জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস (১ অক্টোবর ২০২৫) উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ও শাখা পর্যায়ে নেয়া ১২০০ কর্মসূচির মধ্যে ১১৬৫টি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি জানান, নিসচা এ বছর তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে—
১. মাদ্রাসা শিক্ষক, ইমাম ও শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ
২. দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান চিহ্নিতকরণ ও সংস্কার
৩. জেব্রাক্রসিং ও সাংকেতিক চিহ্ন দৃশ্যমান করা

এছাড়া চালক প্রশিক্ষণ, স্কুলভিত্তিক সচেতনতা, হেলমেট বিতরণ, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, রচনা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বৃক্ষরোপণ এবং প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

সভায় বক্তারা বলেন, প্রতি মাসে শত শত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অন্তত ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান নির্বাচনী ইশতেহারে সড়ক নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত করা ও জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

আরও পড়ুন