জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার »
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করতে গিয়ে সন্ত্রাসী আপন বড় ভাইয়ের কাছে চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন ছোট বোন। দাবি করা ১০ লাখ টাকা না দেয়ায় জমি কিনতে আসা ক্রেতাদের হত্যার হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন ডজন মামলার আসামি বড় ভাই। নিরুপায় হয়ে সাক্ষ্য প্রমাণসহ চলতি বছরে ২৭ মার্চ থানায় এজাহার দিয়েছেন ভুক্তভোগী ছোট বোন। কিন্তু অভিযুক্ত আবুল মনছুর প্রকাশ লুদু ডাকাত কক্সবাজার শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ডজন মামলার আসামি হয়েও থানার বিশ্বস্ত দালাল হওয়ায় পারিবারিক ঝামেলা উল্লেখ করে বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ছয়মাসেও মামলা নেয়নি পুলিশ।
এ ধরনের একটি অভিযোগ করেছেন কক্সবাজার পৌরসভার রুমালিয়ারছরা হাশেমিয়া মাদ্রাসা এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হাজী আবদু ছবুর সওদাগর ওরফে সবুজ সওদাগরের মেয়ে দিল নেওয়াজ বেগম (৪১)। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার টুংগীপাড়া থানার বর্তমান ওসি আবুল মনসুরের স্ত্রী।
তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন এবং ওসির স্ত্রী হয়েও দীর্ঘ ছয় মাসেও কক্সবাজার সদর থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াসের কাছে আইনি সহায়তা না পাওয়া তিনি চরম হতাশায় ভুগছেন। অপরদিকে, মামলার এজাহার জমা দেয়ায় তার বড় ভাইও নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী দিল নেওয়াজ।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, আবুল মনছুর প্রকাশ লুদু ডাকাত তার আপন বড় ভাই। বিত্তবান পরিবারের সন্তান হয়েও তরুণ বয়স হতেই বকে যায় বড় ভাই লুদু। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবন চালানোর ফলে তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় ডাকাতি, অস্ত্র, হত্যা চেষ্টা, হত্যা, সরকারি কাজে বাধা, মারামারি, অপহরণ ও চাদাঁবাজির ধারায় একডজন মামলাসহ একাধিক জিডি রয়েছে। এছাড়াও লুদু শহরের সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশয় দাতা হিসেবেও অভিযুক্ত।
দিল নেওয়াজ বেগম বলেন, আমার ভাই ছোটবেলা থেকেই অপরাধমূলক কাজে যুক্ত। অন্যের জমি জবর দখল বরে চাঁদা আদায় করতে করতে এখন তার আপন বোনের জমি বিক্রি করতে চাঁদা দাবি করছেন।
তিনি বলেন, আমার বাবা ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর শহরের আলীর জাহালের সাইফুল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে ৮ শতক জমি দানপত্র মূলে আমাকে রেজিস্ট্রি করে আমার নামে খতিয়ানও করে দেন। সন্তানকে বিদেশে পড়তে পাঠাতে সেই জমি আমি বিক্রি করতে যাই। তখন আমার ভাই শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী লুদু ডাকাত জমি বিক্রিতে বাধা দেন। জমির ক্রেতাদের হুমকি দিয়ে, খুন করার ভয় দেখিয়ে শাসান। জমি বিক্রি করতে চাইলে আগে তাকে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আমার বাবা-মা দুজনই বেঁচে আছেন। আমার ভাইয়ের সন্ত্রাসীপণা সুরাহা করতে আমরা পরিবারিকভাবে কয়েক দফা বসেছি। কিন্তু আমার বড় ভাই কারও কথা শুনছেন না।
তিনি আরও বলেন, আমার নামের জমি বিক্রিতে আমার অন্য ভাই-বোনদের সমস্যা না থাকলেও লুদু ১০ লাখ টাকা চাঁদার জন্য আমার স্বামী ওসি আবুল মনসুরকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। এনিয়ে চলতি বছরের ২৭ মার্চ আমি সদর থানায় লিখিত এজাহার দায়ের করেছি। কিন্তু সাড়ে ৫ মাস কেটে গেলেও কোনো আইনি সহায়তা দেননি সদর থানার ওসি।
দিল নেওয়াজ বেগম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অতীতে সদর থানায় চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। এছাড়া আমার কাছে যে চাঁদা দাবি করেছে সেই ঘটনার ১৪ জন স্বাক্ষীর নাম-ঠিকানা মোবাইল নম্বর এজাহারে দিয়েছি। তারপরও পুলিশ পরিবারের একজন হয়েও আইনি সহায়তা না পাওয়া চরম হতাশাজনক।
এদিকে, সদর থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদর থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস ও পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম উদ্দিনের সাথে দহরম সম্পর্ক চিহ্নিত সন্ত্রাসী লুদু ও সদর উপজেলার পিএমখালির মাহামুদুল করিম ওরফে দালাল ওসি করিমের। লুদুকে প্রায় প্রতিদিন সদর থানার ওসি ও তদন্তের কক্ষে দেখা যায়। লুদু এবং ওসি করিম সদর থানায় মামলা নথিভুক্ত হওয়া, ফেলে দেয়া, চার্জশীট পক্ষ-বিপক্ষ করা, আসামি বাদ দেয়া এবং ছাড়িয়ে নেয়াসহ অনেক কিছুতেই প্রভাব বিস্তার করেন। এমন সম্পর্কের কারণেই লুদুর বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর মামলাটা নথিভুক্ত করেননি ওসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোর বয়স থেকেই লুদু উচ্ছৃঙ্খল ও বখাটেপনায় জড়িয়ে পড়েন। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ১৯৯৬ সালে তিনি কক্সবাজার সদর থানায় একটি ডাকাতি মামলার আসামি হন। যার জি আর নম্বর ১৪৯/৯৬ এবং এসটি (স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল ) নম্বর ৯৮/৯৮। একই বছরে লুদু জিআর-২৪০ নম্বর মামলার আসামি হন। এরপর ১৯৯৮ সালের জিআর-১৮৩ নম্বর মামলায় অভিযুক্ত তিনি। ২০০১ সালের ৯ মার্চ তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় চাঁদাবাজির মামলা লিপিবিদ্ধ হয়। এরপর তিনি হয়ে উঠে আরও বেপোরোয়া। সেই বছরের ১২ মে তার বিরুদ্ধে একই থানায় হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলা নথিভুক্ত হয়। তার পরের বছর ২০০২ সালে জিআর-৩১ নম্বর মামলার আসামিও তিনি। এরপরের বছর ২০০৩ সালে তার বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। দীর্ঘদিন কোন মামলায় আসামি না হলেও ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল মারামারি অপরাধে তার বিরুদ্ধে ফের মামলা রুজু হয়। তার কিছুদিন পর সেই বছরের ১২ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতি প্রস্তুতি আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে, যা বিচারধীন।
তবে অভিযুক্ত আবুল মনছুর প্রকাশ লুদু বলেন, আমার বোন আমার বিরুদ্ধে যে এজাহার দিয়েছে তা আমি জানি না।
বোনের কাছ থেকে চাঁদাদাবি, একাধিক মামলার আসামি এবং থানার দালালি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোন উত্তর দিয়েই মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন লুদু।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, লুদু খারাপ লোক এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত আপন ভাই-বোন এবং তাদের সমস্যাও পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে। তাই চাঁদাবাজির বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অভিযোগকারীনির স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা। আমরা যদি মামলাটি নিই তবে সেটা ওই কর্মকর্তার প্রভাবের কারণে নিয়েছি বলে সকলেই মনে করবে। তাই বিষয়টি নিয়ে আমি সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশ সুপারের পরামর্শ গ্রহণ করি। পরে বাদিকে বলেছি আদালতের মাধ্যমে পারিবারিক বিষয়টির সুরাহা করতে। কিন্তু তিনি সেটি না করে পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তবে আমি এই চেয়ারে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেব না।
চাঁদাবাজির সাক্ষী থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি অমূলক প্রচারণা। কোনে সাক্ষীই অভিযোগকারী উপস্থাপন করতে পারেনি।
দালালদের সাথে সখ্যতার বিষয়ে ওসি গীয়াস বলেন, আপনারা আমাকে চিনেন, জানেন। আপনারা কি অতীতে কখনও শুনেছেন কোন দালালের সাথে, কোন সন্ত্রাসীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে? আমি কোন দালাল কিংবা ওসির প্রভাবে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ থেকে সরে যাওয়ার মত লোক নই।
বিষয়টি সম্পর্কে বাদিনীর স্বামী গোপালগঞ্জের টুংগীপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, আমি কোন প্রফেশনে আছি সেটা বড় বিষয় নয়- আমার স্ত্রী ও শাশুড়ি মা দেশের নাগরিক হিসেবে আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখেন। জমি সংক্রান্ত বিষয়ে ভাই যদি বোনকে হত্যা চেষ্টা করে, চাঁদাদাবি করে জমি বিক্রিতে বাধা দেয়, কোন অঘটন ঘটান; তখন বোনের স্বামী পুলিশ হলে কি আইনি সহায়তা পাবেন না? এটা পারিবারিক বিষয় বলে তাদের অসহযোগিতা করা যায়?
তিনি আরও বলেন, আমি সদর থানার ওসি মহোদয়কে অনুরোধ করেছিলাম, আপনি মামলা নেন- তদন্তে যদি ঘটনা মিথ্যে পান সংশ্লিষ্ট আইনে আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করিয়েন। কিন্তু এরপরও তিনি চরম অসহযোগিতা করায় আমার সম্মন্ধি বুক ফুলিয়ে ঠাট্টা করছেন!
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহাফুজুল ইসলাম বলেন, আমি নতুন এসেছি কক্সবাজারে। ২৭ মার্চের অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখে জানাবো।













