কক্সবাজার প্রতিনিধি »
প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের উপকূলে বৃহস্পতিবার রাত হতে আঘাত হানতে শুরু করা ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’ শুক্রবার সন্ধ্যা হতে কক্সবাজারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টা নাগাদ হতে কক্সবাজারে হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে এসময় বাতাসে উল্লেখযোগ্য গতিবেগ ছিল না। কিন্তু উপকূলে মাঝারি বেগে বাতাস প্রবাহিত হবার পাশাপাশি জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অমানিশার কারণে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে বলে দাবি করে জেলেরা জানান, কক্সবাজারের উপকূলে জোয়ারের পানি বাড়লেও শুক্রবার সকাল হতেই বিগত দিনগুলোর মতোই ঝলমলে আকাশে বৈশাখের দাবদাহ চলছিল। তবে মাঝে মাঝে সাদা উড়ন্ত মেঘ সূর্যকে অল্পক্ষণ ঢেকে রেখে লুকোচুরি খেলেছে সারাদিন।
কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা দীপক কুমার রায় জানান, সন্ধ্যা হতে ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে দ্বীপ এলাকায়। আছরের নামাজের শেষে উপজেলার দুর্গম এলাকার দূর্যোগপ্রবণ এলাকার হাজারাধিক মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। বাকীদেরও প্রস্তুত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা মাহবুবুল করিম জানান, বৃষ্টিপাত শুরু হলেও শুধুমাত্র রাজাখালী ও টেইটং থেকেই লোকজনকে দিনের আলোতে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেসব এলাকায় আশ্রয়কেন্ত্র নিকটবর্তী সেসব এলাকার স্বেচ্ছাসেবক ও লোকজন নিজেরাই তৈরী হয়ে আছে। প্রয়োজন পড়লেই তারা নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরবে।
আরেক দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর সবচেয়ে দূর্যোগপ্রবণ এলাকা ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান, বঙ্গোপসাগর বেস্টিত দ্বীপ ইউনিয়ন ধলঘাটার অধিকাংশ লোকজন আগেই চকরিয়া কিংবা কক্সবাজারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। বাকি যারা রয়েছেন তারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার পরিকল্পনায় প্রস্তুত রয়েছেন। ঝড়ো হাওয়ায় বৃষ্টি শুরু হলেও সংকেত স্বাভাবিক থাকায় তেমন আতংক নেই। এরপরও ফণির আঘাতে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
শুক্রবার সন্ধ্যা হতে বাংলাদেশের উপকূলে ফণির আঘাত হানতে পারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন শংকায় পূর্বের ঘোষণায় শুক্রবার বিকেলে শুরু হওয়া দুদিন ব্যাপী ডিসির বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা এবং ৪ এপ্রিল উখিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য চাকুরি মেলাও স্থগিত করেছে প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৫৩৮টি সাইক্লোন শেল্টার। মজুদ রাখা হয়েছে ৪শ’ মে.টন জিআর চাউল, সাড়ে ৪ হাজার প্যাকেটজাত শুকনো খাবার। প্রস্তুত রয়েছে ৮৯টি মেডিকেল টীম ও বিভিন্ন সংস্থার প্রায় ১১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আশরাফুল আফসার জানিয়েছেন, উপকূলীয় লোকজনসহ কক্সবাজারে অবস্থানকারি পর্যটকদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সৈকত তীরসহ শহরের জনবহুল স্থানে লাল পতাকা টাঙ্গিয়ে সতর্ক সংকেত বুঝানো হয়েছে। উপকূলে চলমান রয়েছে মাইকিং। সবদিকে সতর্ক নজর রাখতে জেলার সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিটি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের কথা বিবেচনা করে কক্সবাজার ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনারের সাথে আলাদাভাবে সভা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় কক্সবাজার জেলায় ৪৩০টি ইউনিটের আওতায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপির) ৬ হাজার ৪৫০ জন সদস্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও প্রস্তুত রয়েছে ১ হাজার ৭শ’ জন স্বেচ্ছাসেবী। কক্সবাজার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আওতায় প্রস্তুত রয়েছে ১ হাজার ২শ’জন লোক। এরমধ্যে ৭শ’জনকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায়, অন্যান্যদের জেলার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস দূর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনী ওষুধ সামগ্রীসহ প্রস্তুত রয়েছে ৮৯টি মেডিকেল টিম।
একই সাথে কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৬টি ইউনিটের ৩৬জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে ১৩৮জন লোক ও বিদ্যুৎ বিভাগের ৬টি টিম কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। আবার, দূর্যোগকালীন সময়ে জেলা সদরসহ উপজেলা ও উপকূলের প্রায় ৫৩৮ টি সাইক্লোন শেল্টারে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। জেলা শহরে স্কুল সমূহও শেল্টার হিসেবে ব্যবহারে প্রস্তুুতরাখা হয়েছে।
জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান এইচএসসি পরীক্ষাসহ আন্ত:সব ধরণের পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে উপকূলে মাইকিংসহ সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দূর্যোগ কবলীত মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে ১০০ যানবাহন রিকুইজিশন করেছে জেলা প্রশাসন।
দূর্যোগ সংক্রান্ত সকল যোগাযোগের জন্য জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম চালু রাখা হয়েছে। ০৩৪১-৬৪৭৫০ ও ০১৮৮১৬৯৪৮১১ নাম্বারে দূর্যোগ সংক্রান্ত যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছেন জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ড. রইস উদ্দিন মুকুল।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শহিদুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার রাত হতে ঘূর্ণিঝড় ফণি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের উপকূল অতিক্রম করা শুরু করেছে। এর ব্যপ্তি প্রায় ৮-১০ ঘন্টা থাকতে পারে। শুক্রবার সন্ধ্যানাগাদ এর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। এটি শনিবার সকাল পর্যন্ত চলমান থাকতে পারে। দমকা হাওয়াসহ ঝড়-বৃষ্টিতে উপড়ে পড়তে পারে গাছ-পালা, খুটিসহ কাঁচাঘর। ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে উপকূলে।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর













