৮ নভেম্বর ২০২৫

‘সরকারের পদক্ষেপ পোশাক শিল্পকে আরও গতিশীল করবে’

বাংলাধারা ডেস্ক »

বিজিএমইএ’র সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সম্প্রতি সরকার বেনাপোলের পাশাপাশি ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা কাস্টমস স্টেশনের মাধ্যমে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে পার্শিয়াল শিপমেন্টের (আংশিক চালান) জটিলতা নিরসন করে আদেশ জারি করেছে। এতে করে শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখিত স্থলবন্দরগুলো দিয়ে পার্শিয়াল শিপমেন্টে (আংশিক চালান) ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে পারবে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পাদন করা যাবে। বিজিএমইএ দেশের সব স্থল বন্দরের মাধ্যমে সুতা আমদানি ও আংশিক চালানের জটিলতা নিরসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। বর্তমান সরকারের এই পদক্ষেপ গ্রহণ পোশাক শিল্পকে আরও গতিশীল করবে।

রবিবার (২২ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ফারুক হাসান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ আজ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন প্রথম অবস্থানে। সরকারের নীতিগত সহযোগিতায় ইউরোপের বাজারে আমরা অতি শ্রীঘ্রই এক নম্বর অবস্থান নিতে সমর্থ হবো।

‌বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের এই অবস্থানে আসার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, বিগত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, শ্রমিকের কল্যাণ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প নির্মাণে যে পরিশ্রম আমরা করেছি, বিনিয়োগ করেছি এবং সফলতা পেয়েছি, তা সমগ্র বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে। এই অর্জনে উদ্যোক্তা, শ্রমিক ভাইবোন, সরকার, ব্র্যান্ডতো, উন্নয়ন সহযোগী ও সংশ্লিষ্ট অংশীদার সকলেরই অবদান রয়েছে।

পোশাক শিল্পের এই নেতা বলেন, আজ আমাদের পোশাক কারখানাগুলো কেবল নিরাপদই নয়, বরং আরও গতিশীল, আধুনিক, জ্বালানি-সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব হয়ে উঠেছে। ইউএসজিবিসি কর্তৃক প্রত্যয়িত সর্বাধিক সংখ্যক সবুজ কারখানার আবাসস্থল, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ এবং সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব পোশাক প্রস্তুতকারক দেশ হিসাবে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। আমাদের এখন ১৮৩টি লিড গ্রিন কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৬০টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১০৯টি গোল্ড রেটেড। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে ২০২২ সালে আমাদের ৩০টি কারখানা গ্রিন হয়েছে। কোন একক বছরে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রিন কারখানার সংখ্যা। তবে আমরা এখানেই থেমে যেতে চাই না। বিজিএমইএ প্রতিনিয়ত কাজ করছে পোশাকখাতে গ্রিন কারখানার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।

আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, পোশাক শিল্পে সবুজ শিল্প গড়ে তুলতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করার জন্য স্বীকৃতিস্বরুপ বিজিএমইএ ২০২১ টঝএইঈ খবধফবৎংযরঢ় অধিৎফ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। এই প্রথম কোন এসোসিয়েশন টঝএইঈ থেকে এই সম্মাননা পেলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, কোভিড মহামারির কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এক প্রচণ্ড বাস্তবতার সম্মুক্ষীণ হয়। কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি, কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রনোদনা প্যাকেজটি শিল্পকে সেই কঠিন সময়ে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। তবে কোভিড মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যেই পোশাক শিল্প আবারও নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুক্ষীন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারনে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের পোশাক শিল্পে। আইএমএফ এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৩.২% থেকে ২০২৩ সালে ২.৭% এ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি, বিশ্ব বানিজ্যের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৪.৩% থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ২.৫% এ দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি সহ প্রধান বাজারগুলোতে প্রবৃদ্ধি যে হ্রাস পাচ্ছে, তা দৃশ্যমান।

গত দেড় বছরে সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬২%, কন্টেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৫০%-৪৫০%, ডাইস ও ক্যামিকেলের খরচ বৃদ্ধি ৬০%, গত বছরের শুরুতে মজুরি বৃদ্ধি ৭.৫%, গত ৫ বছরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০%-৪৫% বেড়েছে। কোভিডের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনায় খরচ আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যতে কন্টেইনার ও ফ্রেইট খরচ বাড়ানো ছাড়াও নন কটন পণ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল প্রেট্রোকেমিক্যাল চিপস এর দাম আরও বাড়িয়ে দিবে।

অন্যদিকে, বিশ্ব জুড়ে চলমান জ্বালানি সংকটের কারনে স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারনে কারখানাগুলোতে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। এতে করে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা μমবর্ধমানভাবে কমছে। এছাড়া সম্প্রতি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের মূল্য ২০২২ সালের তুলনায় ১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অতি সম্প্রতি সরকার আবাসিক, সার ও চা উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস ছাড়া অন্যখাতে গ্যাসের দাম ১৪ থেকে ১৭৯% পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা কার্যকর হবে ০১ ফেব্রুয়ারি থেকে। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা (৮৮% বৃদ্ধি) হবে। বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে এই দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হচ্ছে (১৫০% বৃদ্ধি)। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্পের ব্যয় বৃদ্ধির এই ভার বহনের সক্ষমতা নেই।

সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, খাত ভিত্তিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের অবদানের কথা বিবেচনা করে এ’খাতকে আরো গুরুত্ব দেয়া। এছাড়া গ্যাস আমদানীর ক্ষেত্রে আমদানীর উপর ভ্যাট ও টেক্স প্রত্যাহার করার জন্য আমি বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা গ্যাস সঞ্চালনে সিস্টেম লস কমিয়ে আনুন, অবৈধ সংযোগগুলো বন্ধ করে দিয়ে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করুন। শিল্পের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করুন। সেই সাথে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করুন। এর পাশাপাশি খঘএ আমদানিতে দীর্ঘ মেয়াদী কন্ট্রাক্টের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিল্পের সকল স্টেকহোল্ডার, উদ্যোক্তা, সরকার, ব্র্যান্ড/ক্রেতা, নীতি নির্ধারক, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সবার ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসে কর যা এ বছরে ১% করা হয়েছে, তা পূর্ববতী বছরের ন্যায় একই পর্যাযে বহাল রাখা হোক। এটি করা হলে উৎপাদন ব্যয় কমবে, শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে, কর্মসংস্থান সুরক্ষিত থাকবে এবং সর্বোপরি রপ্তানি বাড়বে, যা বৈদেশিক রিজার্ভে অবদান রাখবে। আর পোশাক শিল্প শক্তিশালী অবস্থানে গেলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোও উপকৃত হবে। উদীয়মান পরিস্থিতি শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ দুটিই সৃষ্টি করেছে। আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সুযোগগুলো গ্রহন করতে চাই।

নন-কটন বা ম্যান-মেইড ফাইবার ভিত্তিক পোশাক রপ্তানিতে প্রণোদনা প্রসঙ্গে বলেন, টেকসই হওয়ার কারনে বিশ্ববাজারে ক্রেতারা এখন নন-কটন পোশাক পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। টেক্সটাইল খাতের মধ্যে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে ম্যান-মেইড ফাইবার-ভিত্তিক ইয়ার্ন ও ফ্যাব্রিক্স, যেমন পলিয়েস্টার, ভিনকস, স্প্যানডেক্স, মেলাঞ্জ। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে বিশ্ব বাজারে কটন বস্ত্রের শেয়ার এবং পোশাকের ব্যবহার মাত্র ২৬%, সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের ৭৫% কটন পণ্যগুলোতে আবদ্ধ।

যদিও ভ্যালু চেইনে এগিয়ে থাকার জন্য বিজিএমইএ তার সদস্যদেরকে প্রতিনিয়ত সাধারন পোশাকের পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের বা ব্যতিμমী পোশাক তৈরিতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিচ্ছে, তারপরও যারা এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহন করবে, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা থাকা জরুরি। নন-কটন বা ম্যান-মেইড ফাইবার ভিত্তিক পোশাক রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

পাশাপাশি আরেকটি অনুরোধ হলো, নন-কটন বস্ত্র ও পোশাকখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একটি বিশেষ স্কীম গ্রহন করা হোক। এর মাধ্যমে ২০২৯ পরবর্তী সময়ে ডাবল ট্রান্সফরমেশন রুলস প্রতিপালন করে জিএসপি প্লাস এর জন্য আমরা প্রস্তুত হতে পারবো।

শুল্ক ও কাষ্টমস সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার সহজীকরণ প্রসঙ্গে বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকা এবং পরিবর্তিত বিশ্ব বাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্পের জন্য যে সুযোগগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো গ্রহণের জন্য ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো, বিশেষ করে শুল্ক ও কাষ্টমস সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা জরুরি।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, রাকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক আসিফ আশরাফ, মহিউদ্দিন রুবেল, মো. হাসান (জ্যাকি), এম. এহসানুল হক, প্রাক্তন প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, প্রাক্তন সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির ও এ.এম. চৌধুরী সেলিম, প্রাক্তন পরিচালক আ.ন.ম সাইফুদ্দিন, মোহাম্মদ মুসা, অঞ্জন শেখর দাশ, আবদুল ওহাব প্রমুখ।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ