৮ নভেম্বর ২০২৫

সরফভাটায় থামছে না চাঁদাবাজি, অপহরণ— তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ ইউপি সদস্যের (ভিডিও)

শাহরুখ সায়েল »

প্রথমে টার্গেট করে, তারপর সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে টার্গেট করা ব্যক্তির ঘরে। চেয়ে বসে চাঁদা। সেই চাঁদার পরিমাণ হাজার টাকা নয়, লাখ টাকা— কারো কাছে দুই লাখ, কারো কারো কাছে ৫ লাখ। তাৎক্ষণিক দিতে না পারলে সময় বেধে দেয়া হয়, সময়ের মধ্যে দিতে না পারলে দিন দুপুরে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। আত্মীয় স্বজনের কাছে মুক্তিপণ চেয়ে শুরু করে নির্যাতন। মুক্তিপণ আদায় করেই মারধর করে ছেড়ে দেয়। পরে এসব ঘটনা কাউকে না বলতে দেয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ সরফভায় এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পালিয়ে গেছে প্রায় দুইশ’ পরিবার। চাঁদা দিতে না পেরে এসব পরিবারকে উপজেলার পোমরা, ইছাখালী ও বিভিন্ন এলাকায় বাসাভাড়া করে থাকতে হচ্ছে। চিড়িঙ্গা এলাকার প্রায় সব পরিবার পালিয়ে গেছে এমনটাই জানিয়েছে স্থানীয়রা। অনেকে বলছেন, স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে তারা এসব করে ছাড় পেয়ে যায়, প্রশাসনও নিরব ভূমিকা পালন করছে। অথচ সন্ত্রাসীরা একেকজন হত্যা, অপরহণ, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামি বলেও জানা যায়।

তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইউপি সদস্যের ভিডিও বার্তা 

সর্বশেষ রোববার (১৫ মে) রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ড মীরেরখীল এলাকা থেকে তিন ব্যক্তিকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয়রা জানায়, সরফভাটার মীরেরখীল বড়খোলা পাহাড়ে ওই তিন ব্যক্তি কাজ করতে যান। সেখান থেকে সন্ত্রাসীরা তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্গম পাহাড়ে। পরে এলাকায় জানাজানি হলে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশকে অবহিত করে স্থানীয়রা। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের আপহরণ করা হয়েছে বলে জানায় এলাকাবাসী।

এ বিষয়ে সরফভাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘অপহরণের বিষয়টি আমাকে ফোনে জানালে আমি দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ওসির সাথে কথা বলি এবং তাদেরকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে বলেছি।’

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল ইসলাম জানান, সরফভাটার পাহাড় থেকে অপহরণের খবরের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক তারা অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিন পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তাদেরকে উদ্ধার করতে পারেননি। পরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে বড়খোলা ত্রিপুরা সুন্দরী এলাকার দুর্গম পাহাড় থেকে অপহৃত তিনজনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। বর্তমানে তারা পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে পরে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে, গত ৮ মে সরফভাটায় অভিযান চালিয়ে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মো. হারুনকে (৫০) গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার মো. হারুন সরফভাটা ইউনিয়নের জঙ্গল সরফভাটা এলাকার বদিউল আলমের ছেলে।

গেলো বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর অপহরণের ৬৩ ঘণ্টা পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে উদ্ধার হওয়া নুরুল আলমের ভাইয়ের করা মামলায় ওই সন্ত্রাসী দলের মূল হোতা আব্দুস সালাম ওরফে হাত কাটা সালামকে (৬০) মীরেরখীল পাহাড়ি এলাকা ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। সালাম ওই এলাকার নজির আহমদের ছেলে। সরফভাটার ত্রাস এই হাত কাটা সালামকে সন্ত্রসীদের নেতৃত্ব দেয়ার নেপথ্যের নায়ক হওয়ায় এলাকায় ‘বাবা’ হিসেবেও পরিচিত। সরফভাটায় দাপিয়ে বেড়ানো সংঘবদ্ধ স্থানীয় এই সন্ত্রাসীরা সালামের পরিকল্পনায় চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ থেকে শুরু করে হত্যাও করে ফেলে।

জানা গেছে, জেলে যাওয়ার সাত মাসের মাথায় সরফভাটার ত্রাস সেই হাত কাটা সালাম এখন জেল থেকে বের হয়ে আবারও এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।

এরও আগে, জুলাই মাসে সরফভাটায় চাঞ্চল্যকর উকিল আহমদ হত্যা মামলার পলাতক আসামি ইউনুসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জঙ্গল সরফভাটার নিজ বাড়ি থেকে আদালতের পরোয়ানামূলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ মার্চ সকালে রাঙ্গুনিয়ার জঙ্গল সরফভাটার কালিছড়ি এলাকায় নিজেদের সেগুন বাগানে অবস্থান করছিলেন পশ্চিম সরফভাটা গঞ্জম আলী সরকার বাড়ির আবুল কালামের পুত্র উকিল আহমদ (৫৫) ও তার পুত্র মো. ইসমাইল (১৬)। বিক্রি করার জন্য স্থানীয় মো. আলীকে গাছ দেখাতেই তারা সেখানে যান। একপর্যায়ে সেখানে পূর্ব থেকে ওঁত পেতে থাকা ১০-১৫ জন দুর্বৃত্ত অতর্কিতভাবে ধারালো কিরিচ ও দা নিয়ে পিতা ও পুত্রের উপর হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা বৃদ্ধ উকিল আহমদকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেন।

এরপর ধাওয়া করে নিহতের ছেলে মো. ইসমাইলকে কুপিয়ে ডান পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তার একটি হাতও প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় উকিল আহমদের স্ত্রী মমতাজ বেগম বাদী হয়ে ইউনুসসহ ২৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটায় ওসমান বাহিনীর ওসমান ২০১৯ সালে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহতের পর তোফায়েল বাহিনী লিড দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে গত ১০ এপ্রিল মো. মফিজ নামে আরেকজন প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে এলাকায় ওই তোফায়েল বাহিনীর আধিপত্য বিস্তার করে। এতে এলাকার মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়।কামল-তোফায়েল বাহিনী দিন-দুপুরে চাঁদাবাজি, খামারের গরু, মহিষ ও ছাগল চুরি হতে শুরু সব ধরনের লুটপাট শুরু করে। এমনকি তাদের ভয়ে চিড়িঙ্গা এলাকা সব পরিবার এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় চলেও গেছে। চিড়িঙ্গা ছাড়াও মীরেরখীল থেকে প্রায় দুইশ পরিবার বর্তমান এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে সন্ত্রাসীদের ভয়ে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, একেকদিন একেক পরিবারকে দুই লাখ, তিন লাখ, পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এই সন্ত্রাসীরা। এমনকি দিতে না পারলে তুলে নিয়ে দুর্গম পাহাড়ে বেঁধে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে। এই মারধরের বিষয়ে কাউকে কিছু বললে মেরে ফেলারও হুমকি দেয় এই সন্ত্রাসী বাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একজন বলেন, ‘মীরেরখীল গ্রাম নয় শুধু পুরো সরফভাটার মানুষ রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারে না। কারণ, কখন কিভাবে কার ঘরে ঢুকে কি দাবি বসে— সেই ভয়ে থাকে সবাই। অনেকের কাছে লাখ-দেড়লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বসে। আর তা যে কোনভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবস্থা করতে না পারে তাহলে বাড়িতে এসে নানা হুমকি-ধমকি দেয়, এমনকি মারধরও করে। প্রাণের ভয়ে এসব ঘটনা কাউকে জানায় না, থানা গিয়েও কোন অভিযোগ করে না কেউ।’

এলাবাসীদের আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে থাকলেও স্থানীয় ইউপি সদস্য ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় এর প্রতিবাদ করলেও চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতার চুপ। তারা কোন পদক্ষেপ নেন না কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। যদিও তারা সবই জানেন। বলতে গেলে, এটা মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। যখন যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে অথচ সবাই নিশ্চুপ। মানুষ ভোট দিয়ে এই জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করেছে কেন তাহলে, যদি জনগণের নিরাপত্তা দিতে না পারে? এভাবে চুপ থাকলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এখন তো দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া আলাদা থাকাও হয়েছে, তাছাড়া মীরেরখীলে পুলিশ ফাঁড়িও আছে— তবুও চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, অপহরণ তো এখনো কমেনি।’

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এলাকায় দিন-দুপুরে দাপিয়ে বেড়ায় এই সন্ত্রাসী দল। তাদের মধ্যে সবাই স্থানীয় বলে জানা গেছে। তবে স্থানীয় প্রভাবশালী যুব নেতাদের আশ্রয় পশ্রয়ে এরা এসব করতে সাহস পায়, এমনকি আদায়কৃত চাঁদার একটি অংশ এসব নেতাদের পকেটে যায় বলে জানায় ওই সূত্র।

তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইউপি সদস্যের ভিডিও বার্তা

দেখা গেছে, স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. দিলদার হোসেন ঈদের দ্বিতীয় দিন গত ৫ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও বার্তা ছাড়েন। এতে স্থানীয় সাংসদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এলাকার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘প্রিয় নেতা, আধুনিক রাঙ্গুনিয়ার রূপকার ড. হাছান মাহমুদ এমপি মহোদয়কে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি— আপনি আমাদের মীরেরখীল এলাকার প্রতি একটু নজর দিন। আপনার কৃপায় এখানে একটি পুলিশ বিট স্থাপন হওয়ায় অশেষ কৃতজ্ঞ প্রকাশ করছি। আগে দিনদুপুরে যে তাণ্ডবগুলো হতো তা থেকে কিছুটা স্বস্তি মিললেও রাত্রীকালী তাণ্ডব এখনো চলছে।’

ভিভিও বার্তায় তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে কল করে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদা দাবি করে যাচ্ছে। স্থানীয় নেতা ও এলাকাবাসী এতে নির্বিকার। এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কেন হচ্ছে না সেটাও জানি না। এখানে একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গুটি কয়েক সন্ত্রাসী শান্ত মীরেরখীল এলাকাকে অশান্ত করে তুলেছে।’

এলাকার সর্বস্তরের জনগণ ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ইউপি সদস্য দিলদার বলেন, ‘আমাদের মীরেরখীল ও হাজারিখীলকে এগুলো (সন্ত্রাসী) থেকে মুক্ত করতে সহযোগিতা করেন। আপনারা যদি সহযোগিতা করেন, ইনশাল্লাহ, এগুলো অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কখনো সন্ত্রাসীরা এদেশে স্থায়ীভাবে ঠিকতে পারেনি, সামনেও ঠিকতে পারবে না। আপনারা সহযোগিতা করলে এরাও ঠিকতে পারবে না।’

এলাকাবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কেউ চাঁদা দাবি করলে আপনারা চাঁদা দিবেন না, আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। যথাযথ সাহায্য করব, ইনশাল্লাহ। চেষ্টা করব এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য, মোকাবেলা করার জন্য। একজনের দেখা-দেখিতে আরেকজন চাঁদা দিয়ে দিচ্ছে, একজন দিলে আরেক হাসতেছে— এভাতে আমরা গণহারে ওই চাঁদা দেয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছি। কেউ চাঁদা দাবি করলে আমাকে ফোন দিবেন, পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন দিবেন। রাত্রীকালী কেউ যদি এসে দরজা ধাক্কায়- দরজা খুলবেন না, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন দিবেন। আমি যথাযথ চেষ্ট করব আপনাদের পাশে থাকার। এসব অ্যথাচারে বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদেরকে দাঁড়াতে হবে। এতে সন্ত্রাসীদের হাত যত লম্বা হোক না কেন, এলাকাবাসীর সাথে কখনো পেরে উঠবে না। আপনারা সাহস যোগান।’

এসময় তিনি সরফভাটার আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের এগিয়ে এসে মীরেরখীলবাসীকে রক্ষা করার আহ্বান জানান। সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সযোগিতার অনুরোধ জানান তিনি।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ