১ নভেম্বর ২০২৫

সাপের বিষেই বাঁচবে মানুষের প্রাণ! (ভিডিও)

রুবেল দাশ  »

গবেষণাগারজুড়ে বাক্সবন্দি হয়ে রয়েছে বিষধর সব সাপ। একটি দুটি নয়। ১০ প্রজাতির সর্বমোট ১৬০টি সাপ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কেউটে, গোখরা ও চন্দ্রবোড়ার মতো মারাত্মক বিষধর প্রজাতির সাপ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা সাপগুলো সংগ্রহ করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।

এছাড়া গবেষণাগারে ডিম ফুটিয়ে কিছু সাপের বাচ্চার জন্ম দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত আদর-যত্নে এগুলোকে লালন পালন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো এদের বিষ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তা থেকে সাপের বিষনাশক ওষুধ বা এন্টিভেনম তৈরি করা।

জানা যায়, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা মোতাবেক সাপের বিষের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের একটি ভবনে বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ লালন করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৫টি বিষাক্ত সাপ দিয়ে এই ভেনম রিসার্চ সেন্টার শুরু হলেও দুই বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে এই গবেষণাগারে সাপের সংখ্যা ঠেকেছে ১৬০টিতে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজও।

বর্তমানের দেশের সাপে কাটা রোগীদের জন্য এন্টিভেনম আমদানি করে আনতে হয় ভারত থেকে, যা খুবই ব্যয়বহুল। এছাড়া প্রজাতির ভিন্নতার কারণে এক সাপের এন্টিভেনম অন্য সাপের বিষে কাজ করে না। ফলে দেশেই এন্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানান ভেনম রিসার্চ সেন্টারের মূল দায়িত্বে থাকা চমেক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়।

তিনি বাংলাধারাকে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সাপে কাটা রোগীর অ্যান্টিভেনমও আলাদা হয়। এজন্য হু এর নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্বের সব দেশকে নিজেদের সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হবে।’

বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর লাখের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এদের মধ্যে সাপে কাটায় প্রতি বছর ছয় হাজারের মত লোক মারা যায়।

গবেষকরা জানান, কাউকে সাপে কাটলে শরীরে যে বিষ ছড়িয়ে পড়ে তা মূলত বিভিন্ন প্রোটিনের মিশ্রণ। সেটি শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকে। শরীরে ছড়িয়ে পড়া এই প্রোটিনের কার্যকারিতা নষ্ট করতে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় অ্যান্টিভেনম।

বর্তমানে গ্লাস ক্যাপিলারি ও গ্লাস বিকার পদ্ধতিতে পালিত সাপগুলো থেকে বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্যারাফিনের লেয়ার দিয়ে সাপের কামড়ের অনুভূতি তৈরির মাধ্যমে বিষ বা ভেনম সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া বিষদাঁতের সাথে লাগিয়ে গ্লাস ক্যাপিলারি পদ্ধতিতেও বিষ সংগ্রহ করা হয়। তবে বিষ থেকে এন্টিভেনম তৈরি করতে আরো কয়েক বছর লাগতে পারে বলে জানান ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ।

ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, ‘লালন-পালন করা সাপের শরীর থেকে ভেনম সংগ্রহের পর পরীক্ষামূলক ডোজ তৈরি করে ডব্লিউএইচওর নিয়ন্ত্রিত মান পর্যায়ে রেখে তা অন্য কোনো প্রাণী বিশেষ করে উট, ঘোড়া, ভেড়া বা ছাগল জাতীয় প্রাণির শরীরে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে।’

চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ এ গবেষণার মূল দায়িত্বে থাকলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিক্যাল মেডিসিন, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অফ বাংলাদেশ এবং জামার্নির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সহযোগী হিসেবে আছেন।

চমেক হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের সাথে লাগোয়া ভবনের নিচতলায় বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি ঘরে এসব সাপ নিরাপদে বড় হচ্ছে। রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসকদের পাশাপাশি কাজ করছে চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও এখানে পালিত সাপগুলোর তত্ত্বাবধান করে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী এসব সাপের দেখভাল করা হয় বিশেষ ব্যবস্থায়। সাপদের খাওয়ানোর জন্য খাবারও এ প্রকল্পের আওতায় উৎপাদন করা হচ্ছে। আলাদা কক্ষে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর পালন করা হচ্ছে। এছাড়া কোন সাপ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য আলাদাভাবে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয় এখানে।\

সামুদ্রিকসহ বাংলাদেশে ৯০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এর মধ্যে ১৫টি বিষাক্ত প্রজাতি মানুষকে আক্রান্ত করে থাকে।

পুরো প্রকল্প বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর বাংলাধারাকে বলেন, এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ভেনম রিসার্চ সেন্টার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। এ সেন্টারে সাপের বিষ থেকে যে এন্টিভেনম তৈরি করা হবে তা সাপে কাটা রোগীদের প্রয়োগ করা হবে। তখন আর ভারত থেকে আমাদের এন্টিভেনম আমদানি করতে হবে না।

বাংলাধারা/এফএস/এআর

আরও পড়ুন