আরজু মুক্তা »
“আমি নারী; আমি তিনদিকে ছুটি।”
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও, আমার বলতে ভালো লাগে। আচ্ছা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি কী? মাথায় এবার অনেক শব্দের জট। কেউ কেউ বলবেন—মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। আবার একটু এগিয়ে যাওয়া মানুষরা বলবেন—এগুলো তো ধর্ম। হবে, চাইনিজ, মঙ্গোলিয়ান, জার্মান, ইংরেজ। শ্রেষ্ঠত্বের বারোটা বাজিয়ে যখন আমি বলবো, “নারী জাতি!” পিন পতন নীরবতা বইবে; না, পুরুষতন্ত্র চুলচেরা বিশ্লেষণে বসবে; দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
যে পুরুষ নারীকে অধীনস্ত বা ভোগ্য হিসেবে ভাবছেন—তিনি কি একবারও ভাবছেন নারীর গর্ভেই তার জন্ম। নারী না থাকলে এই পৃথিবীতে আসা হতো না। নারী, এমনই শক্তি। যার দ্বারা জগত ও সংসার চলমান।
ক্লারা জেটকিন রাশিয়ায় এক শতাব্দী আগে যে লড়াই শুরু করেছিলেন তা সর্বস্তরের মেয়েরা কি অংশগ্রহণ করেছিলেন বা পেরেছেন কিনা বা তার সদিচ্ছা কতোটুকু ছিলো তা নজরে রাখা প্রয়োজন। অনেক মেয়ে অনেক সময় পুরুষের অধীনস্ত থেকে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। এই ধরণের ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা অবহেলিত। নারী শক্তিকে পণ্য বানিয়ে নারী অহমিকায় আঘাত এনে, নারীকে অবমাননা করার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোথায় যেনো যুদ্ধ জয়ের শৌর্য লাভ করে। সীতার অগ্নিপরীক্ষা আজও চলছে।
নারী পুরুষ সমান সমান। কিন্তু নারীদের কোথাও না কোথাও চূড়ান্ত অবহেলিত ও অমর্যাদাকর জীবনযাপন করতে দেখা যায়। সত্য কথাটা সত্য দিয়ে বিচার করার সময় এসেছে। নারী অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই চলবে যতক্ষণ না নারী তার নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে।
নারী তো পুরুষের সমকক্ষ, আবার কখনো তাদের ছাড়িয়ে। রাজিয়া সুলতানা, ইন্দিরা গান্ধী, ওয়াসফিয়া নাজরিন, ট্রেন চালক সালমা খাতুন। আরও কতো নাম!
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মজীবী। একজন নারী প্রায় ১৬-২০ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। কারণ নিজ কাজ বাদেও—সাংসারিক কাজ এবং সংসারের আবদার মেটানোর কাজ করেন। এটা তিনি বেতন না নিয়ে করেন। অর্থনৈতিক হিসেবে বাজার মূল্য প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
সংসারে সুখ বলি আর অসুখ বলি উভয়েরই জন্য নারী পুরুষ দুজনে অংশীদার। এটা কি পুরুষ মেনে নিবে? তারা দেখে নিজেদের স্বার্থ। নারীর কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক অংশগ্রহণের পর প্রশ্ন ওঠে তাহলে গৃহস্থালির কাজগুলো কি নারীর একার? বর্তমান প্রজন্মও মনে করে, এইসব কাজ করলে সমাজ তাদের মেয়ে মানুষ বা বৌ পাগল বলবে। সভা সেমিনারে যারা আবার বক্তৃতা দিয়ে, নিজেকে জাহির করেন, “আমি আমার বৌকে সাহায্য করি, সহযোগিতা করি, বাচ্চাদের দেখি।” আসলেই কি তারা প্রতিনিয়ত করেন? না, কর্মজীবী নারীরা পুরুষদের সাহায্য করছেন? পুরুষরা কি এটা মেনে নিবেন? একজন পুরুষ তার বাড়িতে কাজ করবে—এতে সহযোগিতার প্রশ্ন কেনো? শব্দের অপপ্রয়োগ। এগুলোই জটিল করে। সম্মান নষ্ট করে। তাহলে, নারী পরিবারের অর্থনেতিক উন্নয়নের মেশিন করে তুলছে নিজেকে। যে একাধারে একজন কর্মজীবী এবং গৃহিণী। দিন শুরু ৪ টায়, শেষ রাত ১ টায়। অথচ সেই পুরুষদের সহযোগিতা ১০% ও বাড়েনি। এই পুরানো মানসিকতা ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।
“কর্মজীবী নারীরা মেশিন না, মানুষ। কাজের কোন নারী পুরুষ নেই। সবগুলো কাজই সবাই করতে পারে।”
নারীকে প্রায়ই দায়ী করা হয়। তারা নারীত্ব ব্যবহার করে পদ পদন্নোতি নেন। তাদের যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা হয়না। এখানে ভাষাগত লিঙ্গ সন্ত্রাসের শিকার।
ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতন, প্রহার, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পুত্রহীনতা, কন্যাসন্তান জন্মদান, লিঙ্গীয় বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য, গণমাধ্যম সন্ত্রাস, প্রযুক্তি সন্ত্রাস, কর্ম বৈষম্য, উচ্চ নীচ বৈষম্য আরও কতো কী? নেতৃস্থানীয় একজন পুরুষের কাছে মানবসৃষ্ট কোন সংবাদ দেয়া হলে, প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, মহিলাটা কে? তিনি বা অধিকাংশ পুরুষের ধারণা, সব গণ্ডগোলের মূলেই নারী!
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৬ আনাই দোষ ধর্ষকের। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে, পুরুষদের কুনজর নিবৃত্ত করার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পান না।
নারী নির্যাতন অবসান ঘটাতে হলে সঠিক আইন ও নীতিমালা বিশেষ করে নারী বান্ধব আইন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে পরিবর্তন না ঘটলে আইনও তেমন কাজে আসে না।
শিশু কিশোর কিশোরীরা যেসব বই পড়ে, সিনেমা দেখে, কার্টুন বা গেমস খেলে এবং পরিবারের নারী পুরুষদের মাঝে যে সম্পর্ক দেখে তা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের উচিত সেই ধরণের সহ পাঠক্রম তৈরি করা। তখন ছেলেরা নারীকে সহযোদ্ধা এবং বন্ধু হিসেবে দেখতে পাবে এবং মর্যাদা দিবে।
আমাদের মেয়েদের এমন ভাবে বড় করতে হবে, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী, উচ্চাকাঙ্খী, সাহসী, স্বাধীনচেতা ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। ছেলেদের অবশ্যই মেয়েদের সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে।
বিশেষ দিন নয়, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে নানা আলোচনা ও কর্মসূচির শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ না রেখে—প্রতিটি দিনেই যেনো নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত না হয় তার শপথ আজ থেকে হোক। আর এই শপথ হোক নারী পুরুষ নির্বিশেষে।
এটাই নারী দিবসের সার্থকতা।
“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী।”
আর জাতীয় কবি নজরুল শেষ করলেন উপরের কবিতাটি একটা অসাধারণ লাইন দিয়ে।
“সেদিন সুদূর নয়
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়গান।”
বাংলাধারা/এফএস/এআর