মোহাম্মদ নূরুজ্জামান
আমাদের সুখলাল সরকারের বৈঠকঘরটি গ্রামের প্রবেশমুখেই ছিল। পূর্বপাড়া-পশ্চিমপাড়া-উত্তরপাড়া- সকলে সেই বৈঠকঘরের পাশ দিয়েই সময়ে অসময়ে যাওয়া-আসা করতো। সুখলালের বাবা-মায়ের অসাধারণ নিরীহপনা ও অপরিসীম ধৈর্যের প্রশ্রয়ে এই ঘরটি হয়ে উঠেছিল কৈশোর-যৌবনে আমাদের সকল বাঁদরামির কেন্দ্রস্থল। আশ্চর্য এই পূণ্যকুঠিরের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেই বয়সের তারতম্য, সম্পর্কের চাচা-মামা সব বাপ বাপ করে বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে পালিয়ে যেত।
অনার্সের ক্লাস শুরু হতে না হতেই রাজ্য দখলের টানা-পোড়েনে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ ঘোষণা। সে এক দারুণ সুসংবাদ। হল ডাইনিংয়ের স্বাস্থ্যবান ভাত আর আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাওয়া মাংশ খাওয়ার পরিশ্রম করতে হবেনা। মনে মনে ভিসি মহোদয়কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাবার হোটেলে মায়ের মধুমাখা ভাত খাই আর বনের মোষ তাড়াই!
সারাদিন হরতন-রুহিতনে মাথাগুঁজে পড়ে থাকা আর পরিকল্পনা করা-রাতে কার রিকশার তালা ভেঙে দুগিয়া বাজারে চা খেতে যাব, জেলেপাড়ার কার নৌকা চুরি করে ভাসানগীত গেয়ে দেওপুরে দেও-দানব খুঁজতে যাব। এমন করে আর কতদিন?
উত্তাল পদ্মায় চর পড়ে-মুনিরও ধ্যান ভাঙে। সবাই সিদ্ধান্ত নেই- এবার গ্রামের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কিছু করবো। কী করা যায়? নাটক মঞ্চায়ন। আমরাই অভিনয় করবো, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সকলে বিভোর হয়ে উপভোগ করবে আর আমাদের মুখে ফুল-চন্দন ছিটাবে। আহা! যেমন কথা, তেমন কাজ।
পরদিনের আসরে হরতনের রাজা আর রুহিতনের রানী মুখথুবড়ে পাশে পড়ে থাকে, আমরা নাটক বাছাইয়ে ব্যস্ত। একজন বলে- ‘সিরাজউদ্দৌলা নাটক হোক। যখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব- বলে আবেগে কাঁপতে কাঁপতে ডায়লগ বলবে, তখন পুরো মাঠ কেঁপে উঠবে।’- ‘রাখ্ তোর সিরাজ’- বলে অন্যজনের প্রবল দ্বিমত। ‘শালার ব্যাটা মিরজাফরের আশেপাশেও আমি নাই। তার চেয়ে কাশেম-মালার প্রেম ফাটাফাটি। নায়িকা মালা হাতে মালা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যখন প্রাণহীন কাশেমের দিকে এগিয়ে যাবে, উহ্!’
হঠাৎ আমার মনে হতেই বললাম, নায়িকা পাবো কোথায়? কেউ একজন বলে উঠলো- ‘কামাইল্যারে নায়িকা বানাইয়া ফালাও। চেহারা গোলগাল, গলার স্বরও চিকন।’ আমাদের একান্ত অনুগত কামালের তখন ভীষণ অভিমান- ‘ভাই, আপনাদের সাথে চলি, শেষমেশ আমারেই মাইয়্যা বানাইবেন। এত শখ অইলে নায়িকা ছাড়াই নাটক করেন।’- দারুণ পরামর্শ! কিন্তু আমরা নায়িকাবর্জিত নাটক খুঁজে হয়রান। সব নাটকেই কাহিনীর ফাঁক-ফোকরে নায়িকা উঁকি মারে।
হঠাৎ ভাগিনা কাঞ্চনের যুক্তি- আমি যেহেতু বাংলায় পড়ি, নিজেই তো একটা নাটক লিখে ফেলতে পারি। শুনেই আমার লেখক লেখক ভাব, চুল-দাড়ি যেন অসময়ে লম্বা হওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। আমি বলি, জীবনে কত চিঠি লিখে কতজনের প্রেম জোড়া দিলাম-একটা নাটক, কোনো ব্যাপারই না। তুমুল আয়োজনে নাটক লেখা শুরু। নায়িকা ব্যাক স্টেজে, মঞ্চে শুধু নায়ক।
সুখলাল নিজের সব খাতা কলম সমর্পণ করে, মাঝখানে একবার তার ঘর থেকে গরম চা-বিস্কুটও এসে যায়। আলামিনের হাতের লেখা সুন্দর, গুটি গুটি অক্ষরে নাটক পাখা মেলতে থাকে। হৃদয়নিঃসৃত নামকরণ ‘প্রিয়ার কান্না’। নায়ক ‘আকাশ’ সড়ক দুর্ঘটনায় অসময়ে মারা যাবে, নায়িকা ‘প্রিয়া’র কান্নায় আকাশ-পাতাল ভারী হয়ে উঠবে। আহ্! আমি কাহিনীকার। জমিদারের মতন বিছানায় হেলান দিয়ে একের পর এক সংলাপ বলি। আটকে গেলে কামাল এসে চুল টেনে দেয়- ঘাড় টিপে দেয়- ‘ভাই, পরেরটা বলেন।’
আমি তখন আকাশ-প্রিয়ার বিরহ সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে বলি- ‘ইতিহাসের দিকে চেয়ে দেখ প্রিয়া। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ-ভালবেসে তারা কী পেয়েছে জীবনে?’ লেখক আলামিন বলে- ‘রোমিও-জুলিয়েটকেও লাগিয়ে দেই।’
এতক্ষণ নীরবে বসে থাকা আরশাদ হঠাৎ প্রবল আবেগে ‘আহা! আহা!’ বলে চিৎকার করে উঠে। বাইরে পথ দিয়ে কোনো এক মুরুব্বি যাচ্ছিলো, রেগে উঠে- ‘বেত্তোমিজ পোলাপাইনের জ্বালায় চলাফেরা মুশকিল।’ আমাদের তখন এতসব শোনার সময় নাই। মহত্তম কোনো সৃষ্টির জন্য লাঞ্চনা-বঞ্চনা সইতেই হয়।
পরদিন নাটক লেখা দেখতে দর্শনার্থীদের ভীড় পড়ে যায়। দরজা একটু ফাঁক রেখে ভাতিজা হযরত পাহারায় বসে মাঝেমধ্যে ধোঁয়া ছাড়ে আর বলে- ‘নাটক লেখা দেখবা? পাইন আপেল বিস্কুট লইয়া আও।’ নাটক বেশ জমে উঠেছে, নায়িকাকে মঞ্চে না এনে আর রক্ষা নেই। সাইদুর প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলে- ‘কাকা, নায়িকা দরকার অইলে কিডন্যাপ করমু। এখন মঞ্চে উঠান, ঝুমুর ঝুমুর নাচান।’
কাহিনী এ পর্যায়ে সিনেমার স্টাইলে নায়ক-নায়িকা পাশাপাশি বসে আছে। সংলাপ চলছে- ‘জায়গাটা খুব সুন্দর, তাইনা প্রিয়া?’ এতটুকু লেখার পর আমরা খাতা বন্ধ রেখে গোসল করতে বাড়ি যাই। ফিরে এসে দেখি, আবেগ সামলাতে না পেরে কাঞ্চন সাহেব পরের সংলাপ লিখে রেখেছে- ‘আমার খুব ভয় হয় প্রিয়া।’
আমরা যতই বলি- সংলাপ মিলে নাই, ভয়ের কথা এখনই না, প্রেমটা আর একটু জমে উঠুক। কিন্তু ভাগিনার অকাট্য যুক্তি-‘কি বলো মামু? সুন্দর জায়গায় সুন্দরী নায়িকা, মনে ডর-ভয় থাকা দরকার। দিনকাল ভালো না।’
নাটক লেখা শেষ হয়। রিহার্সেল শুরু। নায়করা কেউ ঝিমায়, কেউ ঘুমায়। আমি বুঝলাম – নায়িকাকে রিহার্সেলে না তুললে তীরে এসে তরী ডুববে। ব্যক্তিগত বিশেষ অনুরোধে জেলা একাডেমির এক মহিয়সী নারী রাজি হন। রিহার্সেলে সেই সুন্দরী নায়িকার নাম ঘোষণা করতেই নায়কোচিত পারদর্শিতা প্রমাণে সবাই তটস্থ, শেষপর্যন্ত মারামারি অবস্থা। বড়দের সিদ্ধান্ত- যত নষ্টের মূল ঐ নাটক, আগুনে পোড়াও।
সেদিন, আমি নিজ হাতে একটার পর একটা স্বপ্ন পুড়িয়েছিলাম। আকাশকে পুড়িয়ে আকাশে উড়িয়েছি, প্রিয়াকে পুড়িয়ে বাতাসে। আর, নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাবে রাজি হওয়া সেই সহৃদয় নায়িকার উদ্দেশে মনে মনে মান্না দে’র সুর তুলেছিলাম- ‘সে কেন এত সুন্দরী হলো?’
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ













