৪ নভেম্বর ২০২৫

সেন্টমার্টিনে মোখার আঘাত, ১২শ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

সেন্টমার্টিনে মোখার আঘাত, ১২শ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার : অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে তছনছ হয়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপে রোববার (১৪ মে) বেলা দুইটা থেকে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে দ্বীপটির অন্তত ১২শ ঘরবাড়ি। এমনটি জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান।

ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, জেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভা দূর্যোগ কবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ৩লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ দূর্গত লোকজনের ১০ হাজার ৬৬৯ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ২২টি ঘর।

ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি চার শতাধিক নারকেল গাছসহ ভেঙে পড়ে অন্তত কয়েক হাজার গাছগাছালি। ঝড়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির উত্তর পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও পূর্ব দিকের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে দ্বীপের ৩টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে স্থানীয় প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। যাদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থামার পর অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর সদস্যরা স্বজনদের কাছে বা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

মোখার তাণ্ডবকে ১৯৯১ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী দাবি করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, মোখা যখন দ্বীপ অতিক্রম করছিল, তখন সাগরে ভাটা চলছে। মরা কাটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতাও কম ছিল। ভরাকাটাল আর জোয়ার থাকলে ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার গতির মোখা ভিন্ন এক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারতো।

চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে শুরু থেকে প্রচারণা চালানোয় দ্বীপের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। ব্যাপক প্রচারণার ফলে দ্বীপের অধিবাসী প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দা আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। গত কয়েক দশকের একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে এত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে দেখিনি। আগেই নিরাপদে থাকায় তাণ্ডবে কারও প্রাণহানি ঘটেনি।

ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি দ্বীপে , সেন্টমার্টিনে প্রায় সাড়ে ৯শ’ কাঁচা ঘরবাড়ি ও ৩ শতাধিক টিনের আধা পাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে সাতশটি কাঁচা ও ৩৫-৪০টি টিনের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। পুরো দ্বীপে চারশতাধিক নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজারের মতো বিভিন্ন গাছগাছালি। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গৃহহীনদের মাঝে অনেকে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

এদিকে, নাফ নদীর তীরবর্তী জালিয়া পাড়ার বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, প্রশাসনের কথা ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়। বিকেলে ঝড় শেষে ফিরে দেখি, তছনছ হয়েছে ঘরবাড়ি। পাড়ার অন্য ঘরবাড়িও ভেঙে গেছে। এখন কোথায় আশ্রয় নেবো বুঝতে পারছি না।

ঘূর্ণিঝড়ে, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং, শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা এবং ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল। এসব এলাকার মানুষকে সড়ক থেকে গাছ সরাতে দেখা গেছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ১২ শতাধিক ঘরবাড়ির কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। এদের মাঝে যারা স্বজনদের বাড়ি যেতে পারেননি তারা আপাতত আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকবেন। ঘর মেরামতের পর নিজেদের ঘরে উঠতে পারবেন।

ঘূর্ণিঝড় দ্বীপে তাণ্ডব শুরু করলে, আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। অনেকে বিপদ থেকে বাঁচতে আজান দিতে থাকেন। কেউ কেউ মোনাজাত করে আল্লাহকে স্মরণ করেন। আল্লাহর রহমত ছিল বলেই মানুষগুলো প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন, বলে উল্লেখ করে ব্যবসায়ী দিদারুল আলম।

দ্বীপে সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। গত ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময়ও দ্বীপের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে প্রচারণা হয়। কিন্তু সিত্রাংয়ের তেমন প্রভাব পড়েনি। কিছু গাছ ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারের ঝড়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকায় তাণ্ডবও চলেছে সেন্ট মার্টিনে। এর সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো দ্বীপ লন্ডভন্ড হয়ে যেত। আল্লাহর রহমত ছিল বলে ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে হয়নি।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন। এই দ্বীপের প্রায় এক হাজার ২৫০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশাপাশি বেশ কয়েকজন আহত হলেও নিহতের খবর পাওয়া যায়নি। পুরো জেলায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ২৪১ জন উপকূলবাসী জরুরি আশ্রয়ে শেল্টারে যান। তাদের শুকনো ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত তুলপ নেয়ার পর আশ্রয়ে আশা লোকজন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। তবে, যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে ঘর মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুন