চট্টগ্রামের আলোচিত ‘সন্ত্রাসী’ আলী আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবর (৪৪) আরেকদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও দুজন পথচারী—একজন ৮ বছরের শিশু, অপরজন এক যুবক। আহতরা সবাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত আকবর কে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে অপারেশন থিয়েটারে তার চিকিৎসা চলছে।
একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জান্নাতুল বাকী (৩০)। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর মৃত বুলু মিয়ার ছেলে। ঘটনার সময় তিনি পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশের বরাতে জানা গেছে, তিনি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে কর্মরত। বর্তমানে তিনি চমেক হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
আহত অপর শিশু মহিম ইসলাম রাতুলের (৮) বাড়ি দক্ষিণ পতেঙ্গার ফুলছুরিপাড়ায়। সে শওকত হোসেনের ছেলে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাতুলকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ৮৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন।
আহতদের স্বজন কুসুম ও শফি জানান, তাঁদের জানা মতে পতেঙ্গা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘সারোয়ার গ্রুপ’ ও ‘সাজ্জাদ গ্রুপ’-এর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে পথচারী হিসেবে রাতুল ও বাকী গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এছাড়াও হাসপাতালে আসা স্বজনদের দাবি, এই ঘটনায় কারাগারে বন্দী ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেনের অনুসারীরা জড়িত। এর আগে গত ২৯ মার্চ ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি করলে দুজন মারা যান নগরের বাকলিয়া এলাকায়।
আকবর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার মঞ্জু মিয়ার ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে। ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত আকবর ও সরোয়ার।
কারাগারে আটক ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ হোসেনের অনুসারী ও তাঁর স্ত্রী তামান্না শারমিনকে নিয়ে কটূক্তি করে নিজের ফেসবুক আইডিতে প্রায়ই ভিডিও দিতেন আকবর। পাশাপাশি সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্নাও আকবরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে নানা ভিডিও দিতেন। ঘটনার জের এসব ভিডিও থেকে বলেও ধারণা অনেকের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় রাত আটটার দিকে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন আকবর। ওই সময় হঠাৎ ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল এসে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে আকবরকে লক্ষ্য করে। গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অস্ত্রধারীরা চলে যায়। পরে গুলিবিদ্ধ আকবরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে ছুটির দিন হওয়ায় সৈকতে লোকজনের ভিড় ছিল বেশি। হঠাৎ গুলির শব্দে সৈকতে বেড়াতে আসা লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সৈকতে পুলিশি টহল জোরদার না থাকায় প্রকাশ্যে এই গুলির ঘটনা ঘটেছে বলে বেড়াতে আসা লোকজনের অভিযোগ।
পতেঙ্গা বিচের এক ব্যবসায়ী জানান, ঢাকাইয়া আকবর, একজন নারী ও আরও চারজন যুবক—মোট ছয়জন—২৮ নম্বর দোকানে বসেছিলেন। দোকানের এক কর্মচারী তাদের কী খাবার অর্ডার করবেন জিজ্ঞেস করলে, তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই মোটরসাইকেলে করে চারজন যুবক এসে পৌঁছায়। ওই চার যুবকের মধ্যে একজন আকবরকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। আকবর পালানোর চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হন।
ব্যবসায়ী আরও জানান, আকবরের সঙ্গে থাকা চারজন যুবক ঘটনাস্থল থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। আর সেই সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে গুলিবর্ষণকারীরা মোটরসাইকেলে উঠে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ঘটনার সময় মোট ৫টি মোটরসাইকেল ছিল। সুত্রে জানা গেছে, সে সুন্দরী তরুণীর নাম নুসরাত জাহান। সে নগরীর অক্সিজেন এলাকা হতে পতেঙ্গা সৈকতে যান।
ঘটনার সময় গুলিবিদ্ধ আকবর দ্রুত আহত হলেও হুড়োহুড়ি করে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪০০ ফুট দূরে পালিয়ে যান। সেখানে পতেঙ্গা বিচের এক কোণে অন্ধকারে লুটিয়ে পড়ে যান। পরে স্থানীয়রা তার চিৎকার শুনে সেখানে গিয়ে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন। তবে অনেকেই জানিয়েছেন, আকবরের হাতেও একটি অস্ত্র ছিলো। তা উদ্ধার বা কোন তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আহত আকবর কাঁদতে কাঁদতে নিজেই বলতে থাকেন, ‘আমাকে পুলিশ চেনে, আমার নাম ঢাকাইয়া আকবর। আমাকে গুলি করছে রায়হান, খোরশেদ, ইমন, বোরহান। মেয়েটার সাথে আজকেই আমার প্রথম দেখা, এর আগে কখনো দেখা হয়নি। আমাকে দ্রুত মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান।’
আহত ঢাকাইয়া আকবরের শরীর থেকে তখন প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যা ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়। চমেক হাসপাতালের ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা জানান, ঢাকাইয়া আকবরের শরীরে মোট সাতটি গুলির আঘাত রয়েছে। তার পা, বুকে, হাতে ও পেটে গুলি লেগেছে। এ ছাড়াও আহত শিশু রাতুলের ডান হাতে এবং অন্য এক যুবক বাকীর পায়ে গুলির ক্ষত রয়েছে।
পতেঙ্গা সৈকতে ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়রা ৭টি গুলির খোসা সংগ্রহ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা এসব গুলির খোসা দেখে বলেন, ‘এগুলো সম্ভবত ৯ মিমি পিস্তলের গুলির খোসা। খোসাগুলো ছোট এবং সিলিন্ডার আকৃতির, যা রিমলেস (rimless) ধরনের কার্তুজ, সাধারণত আধুনিক হ্যান্ডগানে ব্যবহৃত হয়। তিনি আরও জানান, এগুলো সম্ভবত 9×19mm Parabellum কার্তুজ, যা বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র হিসেবে অপরাধীরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। এই ধরনের গুলি সাধারণত ব্যবহৃত হয় ৯ মিমি পিস্তল যেমন Browning, Glock, Beretta এবং কিছু উপমেশিনগান (SMG) যেমন Uzi, MP5-এ।’
সিএমপি বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সোহেল পারভেজ বলেন, ‘এই হামলা পরিকল্পিত। আকবরের শরীরে একাধিক গুলি লেগেছে। হামলাকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। হামলার ধরন দেখে আমরা বলছি, এটি সন্ত্রাসী চক্রেরই কাজ।’
প্রাথমিক তদন্তে এটিকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘টার্গেট কিলিং’-এর ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পুরনো অপরাধী গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মল থেকে গ্রেপ্তার হন সন্ত্রাসী সাজ্জাদ। এরপর ২৯ মার্চ নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোডে একটি প্রাইভেট কারকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়, যার ফলে দুজন নিহত হন। তবে গুলিবর্ষণে গাড়িতে থাকা ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন বেঁচে যান।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার এক আসামি আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, এলাকার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়া সহ মোট পাঁচটি কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সরোয়ারকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাজ্জাদ বর্তমানে কারাগারে থাকলেও তাঁর অনুসারী বেশির ভাগ ‘সন্ত্রাসী’ এখনও আটক হয়নি।
এএস/বাংলাধারা