১ ডিসেম্বর ২০২৫

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে অস্থিরতা: অনিয়ম–দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু এমডি হাবিবুর

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইউনিয়ন ব্যাংকে দায়িত্বে থাকাকালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন, এস আলম গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা প্রদান, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি ঋণ জালিয়াতি মামলায় চার্জশিটভুক্ত থাকা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও পুনরায় এমডি পদে নিয়োগ পাওয়া এসব বিষয় ঘিরে প্রতিষ্ঠানজুড়ে চলছে নানা আলোচনা।

জানা গেছে, এসব অভিযোগ সামনে আসার পর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভেতরেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং পরিচালনা পর্ষদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থানে একাধিকবার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাংকের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের পৃথক তদন্তে দেখা গেছে, হাবিবুর রহমান ইউনিয়ন ব্যাংকের বিনিয়োগ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন সময়ে ২,৬০৭ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনে তিনি সরাসরি ভূমিকা রাখেন। এসব ঋণ কাগজে-কলমে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে দেওয়া হয়, আর তদন্তে দেখা যায় প্রকৃত সুবিধাভোগী হিসেবে উঠে এসেছে এস আলম গ্রুপের নাম।

বিএফআইইউ–এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭২ শতাংশই এস আলম গ্রুপ ও তাদের নিয়ন্ত্রিত বা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে গিয়েছে। সন্দেহজনক ও মূল্যহীন জামানত, ফাঁপা কাগুজে প্রতিষ্ঠান এবং নিয়মবহির্ভূত ঋণ প্রক্রিয়ার কারণে এই ঋণগুলোর অধিকাংশই পরে খেলাপি হয়ে পড়ে, যা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পরও জটিলতা

ইউনিয়ন ব্যাংক ছাড়ার পর তিনি অদৃশ্য ক্ষমতার বলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। তবে তদন্তে তার নাম উঠে আসার পর বোর্ড তাকে ৩০ অক্টোবরের সভায় ৯০ দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বোর্ডকে একটি চিঠি পাঠানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত হাবিবুর রহমানকে এমডি হিসেবেই দায়িত্ব চালিয়ে যেতে দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বোর্ডের আরেক অংশকে বিস্মিত করে এবং ব্যাংকের ভেতরে অবস্থানগত বিভাজন তৈরি হয়। বোর্ডের কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করেন, পুনর্বহালের পর হাবিবুর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিত অভিযোগ জমা দিতে থাকেন এবং ব্যাংকের ভেতর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত করার চেষ্টা করেন।

অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকে তদন্তাধীন থাকা কিছু কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে এনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান, যা অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পুরনো দুর্নীতি মামলা

হাবিবুর রহমান আরও আগে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ১১ কোটি টাকার একটি জালিয়াতি মামলায় চার্জশিটভুক্ত হন। অভিযোগ রয়েছে, একটি অপ্রতুল জামানতের ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদন করে পরবর্তীতে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরি করা হয়। এই মামলায় দুদক ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালকেরা জানান, পরোয়ানার বিষয়টি ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হওয়া এড়াতে গোপন রাখা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় বোর্ড তাকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠায়। এরপর হাবিবুর পদত্যাগপত্র দেন, যা গ্রহণও করা হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় তাকে পুনরায় এমডি পদে ফিরিয়ে আনা হয়।

হাবিবুর রহমান পুনর্বহাল হওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের ভেতরে স্পষ্ট মতভেদ তৈরি হয়। কয়েকজন পরিচালক দাবি করেন, তিনি ফিরে এসে অন্তত ১০০ কর্মীকে বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করান, যা ব্যাংকের ভেতরে অস্থিরতা ও ভয়ভীতি তৈরি করেছে। এ ছাড়া, যে কর্মকর্তারা ইউনিয়ন ব্যাংকের জালিয়াতি ঋণ তদন্তে অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে দু’জনকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান জানান, ইউনিয়ন ব্যাংকে তিনি কেবল নথি অনুযায়ী ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষর করতেন এবং জানতে পারতেন যে এসবের পেছনে এস আলম গ্রুপ যুক্ত। তবে তার দাবি, ব্যাংকটি যেহেতু একটি গোষ্ঠীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মামলাকে তিনি ‘সাধারণ ঋণক্ষতি’ বলে মন্তব্য করে বলেন, আমি কোনো আর্থিক সুবিধা নেয়নি বরং আমাকে ষড়যন্ত্র করে মামলায় জড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকই প্রস্তুত করেছে, তাই অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমস্ত প্রতিবেদন নিয়ন্ত্রক ও নীতি বিভাগে পাঠানো হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।

তিনি আরও বলেন, একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ বা অপসারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কোনো অন্যায় বা অসঙ্গতি এড়াতে এসব প্রস্তাব তারা কখনোই তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদন করে না।

আরও পড়ুন