৩ নভেম্বর ২০২৫

স্বপ্নের কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্প (পর্ব-১)

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»

কক্সবাজার যাবে ট্রেন। স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে পর্যটকদের। মেগা সিটিতে রূপ নিবে ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সমুদ্র সৈকত সিটি কক্সবাজার।  সৈকত সিটি কক্সবাজারকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ১৮ হাজার কোটি টাকার অগ্রাধিকার প্রকল্পের বাস্তবায়ন হচ্ছে অর্শ্বের গতিতে। তহবিলের কমতি নেই, শুধু সময়ের ব্যাপার বাস্তবায়ন। দোহাজারি হতে রামু হয়ে কক্সবাজার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেল লাইন প্রকল্প নির্মাণে প্রায় ১৪শ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ৩৯টি মেজর ব্রিজ এবং ১৪৫টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। ২০২২ সালের জুন মাসে চালু হওয়ার কথা থাকলেও সময় বাড়িয়ে তা ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

করোনা সময়ে গত দুইমাস কাজ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ ছিল। তাছাড়া বাস্তবায়ন ও ট্রায়াল কাজে সময় বৃদ্ধি করা হলে প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন কষ্টসাধ্য এমন তথ্য দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান। বিভিন্ন শ্রেণীর ৯৬টি লেবেল ক্রসিং ও ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এলাকায় একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। দোহাজারি থেকে ৯টি রেল স্টেশন নির্মাণের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে তৈরি হবে জংশন স্টেশন।

অপরদিকে, রামু হতে মিয়ানমার পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ রেল লাইন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩টি মেজর ব্রিজ ও ৪৫টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মিত হবে। এক্ষেত্রেও ২২টি লেভেল ক্রসিং ও একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। তবে ওভারপাস নির্মাণের মূল কারণ হচ্ছে হাতি চলাচল নির্বিঘ্ন করা। কারণ, চকরিয়ার পর থেকে ডুলাহাজারা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলের সময় রাতের বেলায় হাতি পারাপার চোখে পড়ে। ফলে রেল লাইন প্রকল্পে হাতি চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণের মাধ্যমে ট্রেন চলাচলের জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত উখিয়া ও গুনদুম দুটি স্টেশন তৈরি করা হবে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের মধ্যে দোহাজারি পর্যন্ত প্রায় ৪৯ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ করা হবে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। ১৩০ বছর আগের ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশই এ রেল লাইন প্রকল্পের জন্য কয়েকদফায় সমীক্ষা চালিয়েছে। ১৮৯০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রামু হয়ে কক্সবাজার থেকে গুনদুম পর্যন্ত সর্বপ্রথম রেল লাইন প্রকল্পের জন্য সার্ভে করেছিল। দ্বিতীয় সার্ভে করা হয়েছে ১৯১৭ সালে। তখন দোহাজারি হতে রামু হয়ে মিয়ানমারের আকিয়াব পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯৫৮ সালে পূর্ব বাংলা রেলওয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের জন্য সার্ভে করে।

এদিকে, স্বাধীনতার পর জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস ( জেআরপিএস) ১৯৭১ সালে এ রেল লাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সমীক্ষা করে। ১৯৯২ সালের এপ্রিলে ট্রান্স এশিয়া রেলওয়ে নেটওয়ার্কের তিনটি ইউরোপ-এশিয়া সংযোগ রোডের মধ্যে সাউদার্ন করিডোর হিসাবে অন্যতম রুট চিহ্নিত হয়। ১৯৯৫ সালে সাউদার্ন করিডোর -১ এর প্রাথমিক স্টাডি পরিচালনা করা হয়। ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ব্যয় ধরে ২০১০ সালে চূড়ান্তভাবে এ প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৬৭০ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং প্রকল্পের সাহায্য হিসাবে ১ হাজার ১৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০১০ সালের জুলাই মাসে। বর্তমানে দুটি পর্যয়ে ব্যয় হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়েছে দোহাজারি পুরাতন স্টেশন থেকে আরো দেড় কিলোমিটার পর থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত। সড়ক পথে চলতে গেলে এখনও দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন। দ্রুততম গতিতে চলছে ভূমি অধিগহণের পর অবকাঠামোগত বাস্তবায়ন। নির্মাণ করা হচ্ছে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩৯টি মেজর ব্রিজ। এসব ব্রিজ নির্মাণে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হলেও ১৪৫টি মাইনর ব্রিজ তৈরিতে সময় লাগছে কম। সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক স্থাপনের পর ৯৬টি লেভেল ক্রসিংয়ে বেরিয়ার স্থাপন করা হবে। ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এলাকায় হাতি পারাপারের জন্য ওভারপাস তৈরির মাধ্যমে রেল ট্র্যাক স্থাপন করা হবে।

জানা গেছে, দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে স্থানীয়দের ১ হাজার ৩৯১ একর ভূমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনও এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৯টি রেল স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্টেশনের অবকাঠামোগত বাস্তবায়নও চলছে দ্রুতগতিতে। এ প্রকল্পে ৯টি রেল স্টেশন হচ্ছে দোহাজারি, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার জংশন স্টেশন। আধুনিক ও নয়নাভিরাম রেল স্টেশন তৈরি হচ্ছে এ প্রকল্পে। এ ধরনের স্টেশন দেশের কোথাও নেই, এমনটিই দেখা গেছে কম্পিউটার ডায়াগ্রামের মডেলে।

রামু থেকে মিয়ানমারের গুনদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেল লাইন প্রকল্পের মধ্যে মেইন লাইন ২৮ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার ছাড়াও লুব এবং সাইডিং ৩ দশমিক ৯১ কিলোমিটার। এ রেল লাইন প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে। বাস্তবায়নের সময় ১৩টি মেজর ব্রিজ নির্মাণের পাশাপাশি ৪৫টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। বিভিন্ন এলাকায় সড়ক পথগুলো অতিক্রম করতে ২২টি লেবেল ক্রসিং ও ১টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।

এছাড়া হাতি চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণের জন্য সেখানে অত্যাধুনিক ক্যামেরাও স্থাপন করা হবে হাতি পারাপার পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ, ট্রেন চলাচলের সময় হাতি পারাপার যেন বিঘ্নিত না হয়। সে জন্য রেললাইনের ওপর দিয়ে ওভারপাস রাখা হবে হাতি পারাপারের জন্য। রামু থেকেই মিয়ানমারের গুনদুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র একটি স্টেশন তথা উখিয়া রেল স্টেশন বিদ্যমান করা হবে। অর্থাৎ রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত মোট তিনটি রেল স্টেশন থাকছে। এগুলো হল রামু জংশন স্টেশন, উখিয়া রেল স্টেশন ও মিয়ানমার সীমান্তে গুনদুম স্টেশন। ৩৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকেও পুনর্বাসন করবে সরকার। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বাংলাধারা প্রতিবেদককে বলেন, দোহাজারি থেকে ৯টি স্টেশনের মাধ্যমে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল ট্র্যাক নির্মাণের কাজ চলছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রামু হয়ে গুনদুম যাওয়ারও পরিকল্পনা। উভয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১ হাজার ৭৪১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনও করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে পর্যটকদের সুবিধার্থে। হাতি চলাচল সহজতর করতে ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এলাকায় ওভারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ শেষে অবকাঠামোগত বাস্তবায়নের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ