২ নভেম্বর ২০২৫

স্বপ্নের কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্প কেন পিছিয়ে (শেষ পর্ব)

মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক»

প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম কক্সবাজারে স্বপ্নের রেল লাইন প্রকল্প । ফাস্ট ট্র্যাক এই প্রকল্পটি এখন স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।  ডেভলপমেন্ট প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান(ডিপিপি) অনুযায়ী ২০১০ সালের পহেলা জুলাই থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছিল বাস্তবায়ন সময়। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার রেল কর্মকর্তাসহ প্রকল্প পরিচালক। ভূমি অধিগ্রহন থেকে শুরু করে ভূমির মালিকানা হস্তান্তর জটিলতাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এরপর বিদ্যুত বিভাগের হেলাফেলা আর দায়িত্বহীনতাও এ প্রকল্প বাস্তবায়নকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে।

এছাড়াও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। তবে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে গিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আরো কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০২০ সালে করোনাকালীন প্রায় দুই মাস কাজ বন্ধ থাকার পর কাজে চলে আসে ধীরগতি। এছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সকল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো নিরসনে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রস্তাবনা দেয়া হয় প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বৃদ্ধি করা না হলে, এখন থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত  মাত্র ৯ মাস সময় রয়েছে। এই স্বল্প সময়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয় এমন মন্তব্য করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যা চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলা থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী ভূমি অধিগ্রহণ ও মালিকানা হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের বিলম্ব এ প্রকল্পের উন্নয়নে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি অবকাঠামোগত উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি নির্মাণ কাজে নিয়েজিত ঠিকাদারদের চুক্তির শর্তানুযায়ীও নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না।

জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় কিছু ভূমি ২০১৮ সালের শেষের দিকে এবং কিছু ভূমি ২০১৯ সালের শেষের দিকে অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। প্রকল্প এলাকাভুক্ত জমির জেলাপ্রশাসন থেকে রেলওয়ের কাছে হস্তান্তরের পর আবার জমির দখল নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় কোন কোন মালিকানা বুঝে নিতে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

প্রকল্পটি এশিয়ান ডেভলপমেন্ট  ব্যাংক (এডিবি)এর অর্থায়নে অনেকটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে এডিবি’র সেইফ গার্ড পলিসি অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই ক্ষতিপূরণ প্রদানের বাধ্যবাধকতা শর্তে ছিল। প্রকল্পে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই জমির ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। শুধু তাই নয় প্রকল্পের কিছু কিছু অংশে এখনও ক্ষতিপূরণের কাজ শেষ হয়নি। এরপরও শতভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর এই অগ্রাধিকার প্রকল্পটির কাজ থেমে নেই স্থানীয়দের সহযোগীতার কারণে। প্রকল্পের শতভাগ ভৌত নিার্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে এমনটিই সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা গেছে কক্সবাজারে স্বপ্নের রেল লাইন প্রকল্পের স্পট ঘুরে।

এদিকে প্রকল্প এলাকায় ১৬৫ একর বনাঞ্চল সরকারী গেজেটভুক্ত ছিল। যা ডি-রিজার্ভকরণসহ প্রকল্প কাজে ব্যবহারের জন্য নেয়া হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রনালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে এ ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় থেকে প্রকল্প এলাকায় থাকা বণভূমির গাছ কর্তনের অনুমতি পেতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন সীমা পিছিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঠিকাদাররা প্রকল্পের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার গাছ কর্তনের কাজ শুরু করে। এতেও প্রায় কয়েকমাস সময় বেশি লেগেছে। ফলে কাজের ধীরগতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপন কাটিয়ে উঠতে বর্ধিত সময়ের প্রয়োজন এমনটি জানালেন প্রকল্প পরিচারক ও প্রকৌশলী মফিজুর রহমান।

অপরদিকে, প্রকল্প এলাাকা থেকে বৈদ্যুতিক পোল ও ক্যাবল স্থানান্তরের জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ(পিজিসিবি), বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ড(বিপিডিবি), বাংলাদেশ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড(বিআরইবি) এর সমন্বয়হীনতার কারণে বিদ্যুতের পোল বা পিলার বা খুঁটি এবং ক্যাবল স্থানানন্তরের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে। এসব সংস্থা বা দফতরগুলোর চরম অসহযোগীতার কারণে এই অগ্রাধিকার প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়েছে বলে জানালেন সিভিল ও ইঞ্জিনিইয়ারিং বিভাগের কয়েক প্রকৌশলী।

আরো জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট বিদ্যুত বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদাকৃত অর্থ ব্যাংকে জমা ও পোল এবং ক্যাবল স্থানান্তর পক্রিয়া আদৌ শেষ হয়নি। ফলে বিভিন্ন স্থানে আংশিক প্রকল্প বাস্তবায়ন আটকা পড়েছে। এ বিষয়ে সুরাহার জন্য রেল মন্ত্রনালয় , জ্বালানী ও বিদ্যুত মন্ত্রনারয়ের মধ্যে আন্তঃ মন্ত্রনালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে চার দফায়। মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও পোল বা খুঁটি স্থানান্তর প্রক্রিয়া এখনো আটকা পড়ে আছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে।

প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ফলে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ওই বছরের ১২ মে পর্যন্ত প্রায় দেড় মাস কাজ বন্ধ ছিল। সরকারী কঠোর বিধি নিষেধের কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন আরেক দফায় পিছিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের অনুপস্থিতির কারণেও কাজে আবারো ধীর গতি দেখা দেয়। এছাড়া বিশ্বব্যাপী লকডাউন ও আমদানী বন্ধ থাকায় প্রকল্পে ব্যবহৃত সামগ্রীর ঘাটতি পূরণ করা যায়নি। যা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি ট্র্যাক স্থাপনে আরো বেশী সময় ব্যয় হবে।

অপরদিকে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপসহ একাধিক ঘুর্ণীঝড়ের আশঙ্কা তথা ফণী, বুলবুল, আম্ফান, আইলা ও ইয়াসসহ নানা নিম্নচাপ ও ঘুর্ণীঝড়ের আশঙ্কায় প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বাংলাধারা প্রতিবেদকের সঙ্গে আপালচারিতায় জানালেন, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রথম ধাপে ট্রেন চলাচল করবে ১০১ কিলিামিটার। এরপর রামু হতে মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে দ্বিতীয় ধাপে। সাময়িক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারনে সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প আরো দু’বছর বাড়িয়ে ১জুলাই ২০২২ হতে ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন। এতে প্রধানমন্ত্রীর এ অগ্রাধিকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আর কোন ধরনের বেগ পেতে হবে না।

বাংলাধারা/এফএস/এফএস

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ