দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে পূঁজি করে গত ২৮ অক্টোবর থেকে দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। সেই সূত্র ধরে হরতাল-অবরোধে চরম বাজে অবস্থা পার করেছে কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপনের দিন হতে কক্সবাজারে শুরু হয় লক্ষ্যণীয় পর্যটক আগমন। কিন্তু এ শুভ সুচনার যাত্রা দীর্ঘায়িত হবার পূর্বেই ’শনির দশা’য় আটকে গেছে লাখো মানুষের কর্মযজ্ঞ।
গত ২৮ অক্টোবরের পর হতে হরতাল-অবরোধে সে যাত্রায় ভাটা পড়েছে। গত একটি মাস কঠিন গ্লানি টানছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। গত ৩৫ দিনে কক্সবাজারের পর্যটন খাতের সকল অনুষজ্ঞে প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা।
সূত্র মতে, বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর শুক্র-শনিবার বাদে অবরোধ-হরতার, ভরা মৌসুমেও পর্যটন স্পট গুলোকে জন-মানব শুণ্য করে দিয়েছে। এতে সেই করোনাকাল ও ২০১৪ সালের মতো আবারো দেখা দিয়েছে পর্যটন শিল্পে অশনি সংকেত। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে অনেক হোটেল-মোটেল-রেস্তোরা ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টান। যার ফলে জেলার পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টানে কর্মরত প্রায় অর্ধলাখাধিক কর্মজীবির মাঝে বিরাজ করছে ছাটাই আতংক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হলে এ শিল্পে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন নেতা ও তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস’র পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, পর্যটন দেশের অপার সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। বিশ্বের দীর্ঘতম অখন্ড বালিয়াড়িকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারেই এ শিল্প বিকাশের সুযোগ রয়েছে। এখানে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করতে উদ্দোক্তা হিসেবে আমরা সমুদ্রপারে হাজার কোটি টাকা গেড়ে ফেলেছি। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে থেমে থেমে যে অশুভ কান্ড দেশে ঘটছে তাতে এখানে বিনিয়োগকারিরা চোখে সরষের ফুল দেখছেন। ২০১৪ সালের জ্বালাও-পোড়াও, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাকান্ড, ২০১৯ সালের শেষের দিকে করোনাকান্ড আর এখন পর্যটনের ভরা মৌসুমে এসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এ সময় পর্যটকে টৈ টম্বুর থাকার কথা পুরো সৈকত এলাকা। সাচ্ছন্দ্যে পর্যটক আসতে পারলে দু’পয়সা আয় করা যেত। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সময়মতো বেতন ভাতা প্রদানের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের কিছুটা হলেও শোধ করা সম্ভব। কিন্তু এখন পুরো পর্যটন এলাকায় স্থানীয় কিছু দর্শণার্থী এলেও পর্যটক নেই। ব্যাংক ঋণ দূরে থাক হোটেলে কর্মরতদের বেতন ভাতা পরিশোধ, তিন বেলা খাবার এবং আনুসাঙ্গিক খরচ মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাধ্য হয়ে হোটেল বন্ধ করার মতোর কঠিন সিদ্ধান্তের পথে হাটতে হবে।
ট্যুরস ওনার্স এসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫শ’ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও চার শতাধিক রেস্টুরেন্ট। কিন্তু দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কক্সবাজার এখন প্রায় পর্যটকশূন্য। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক রেস্টুরেন্ট। এ ছাড়া খরচ পোষাতে না পেরে কর্মচারী ছাঁটাই ও হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউসগুলো বন্ধ হতে বসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসায় লোকসানের মাত্রা বেড়ে দেনার পরিধি বহুগুণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
হোটেল মোহাম্মদীয়া গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বলেন, টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটন রাজধানী হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার পর্যটকশূন্যই বলা যায়। গত একমাসে আমাদের অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলা রেস্তোরা মালিক সমিতির নেতা রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, হরতাল-অবরোধের প্রভাবে পর্যটক নেই, নেই বেচাকেনাও। ফলে কর্মচারীদের বেতনও যোগাড় হয়নি। বর্ষা ও গ্রীষ্মে কোনমতে ব্যবসাচালিয়ে শীত মৌসুমে পর্যটক সমাগম বাড়লে জমিয়ে ব্যবসা করা যায়। কিন্তু এবার ঋণের বোঝা বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে রেস্তোরা বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের হিসাব বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, হরতাল-অবরোধে বুকিং প্রায় শূন্য। এ সময়ে যেসব পর্যটকরা আগাম বুকিং দিয়েছিলেন তারাও তা বাতিল করছেন। দ্বাদশ নির্বাচন শেষ না হওয়ায় পর্যন্ত আর পর্যটকসমাগম স্বাভাবিক হবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। গত ৩৫দিনে আমাদের গড়ে ১০ লাখ টাকা করে লোকসান হয়েছে। কিন্তু প্রায় ৩শ, স্টাফের খাবারসহ আনুষাঙ্গিক সকল ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। গত হওয়া মাসে বেতন-ভাতা দিতে ভোগান্তি পোহাতে হবে।
কক্সবাজার হোটেল-গেষ্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, টানা হরতাল-অবরোধের কারণে পর্যটন জোনের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস প্রায় ফাঁকাই যাচ্ছে। বিগত ২০১৩ সাল ও ১৪ সালেও একইভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিলেন। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, হরতাল ও অবরোধের কারণে এবারও আশায় ‘গুড়েবালি’। ফলে পরোনো লোকসানে পড়বো এতে কোন সন্দেহ নেই।
কক্সবাজার আবাসিক হোটেল-মোটেল ও গেষ্ট হাউজ শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র জানায়, পর্যটক শূন্যতায় মালিক পক্ষ অনেককে বাধ্যতামূক ছুটি দিয়েছেন। খরচ পোষাতে না পেরে কর্মচারী ছাঁটাই হচ্ছে। ফলে হোটেল-মোটেল ও গেষ্ট হাউজের সাথে জড়িত প্রায় অর্ধলাখ শ্রমিক-কর্মচারী অসহায় দিন যাপন করছেন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা জানান, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কক্সবাজার এখন পর্যটকশূন্য। আবাসিক ও রেস্তোরা খাতে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। পর্যটনের অন্যান্য অনুষঙ্গে আরো ৫ কোটি টাকার ক্ষতি মিলিয়ে দৈনিক ১৫ কোটি টাকায় গত ৩৫ দিনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এসময় পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হতো। এখন ফাঁকা সৈকতে পুলিশ সদস্যরাও অলস সময় কাটাচ্ছেন।













