২৪ অক্টোবর ২০২৫

হালদায় ফেলা হচ্ছে বর্জ্য

মুহাম্মদ আব্দুল আলী »

বহু বছর ধরে চট্টগ্রামের মৎস্যক্ষেত্রে অবদান রাখা হালদা নদী তার বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করেছে। বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী। প্রতিদিনই হালদা পাড়ের হাট বাজারের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। এটি যেন ময়লা আবর্জনার ডিপো। এতে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি। সূত্রে জানা যায়, হালদা নদীতে প্রতিবছর কার্প জাতীয় রুই, কাতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ ডিম ছাড়ে। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দখল–দূষণ অব্যাহত থাকলে শিগগিরই প্রাণ হারাবে হালদা নদী, হ্রাস পাবে মৎস্য প্রজনন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফটিকছড়ির নাজিরহাট পুরাতন ব্রিজ থেকে নারায়ণহাট পুরাতন ব্রিজ, ভুজপুর রাবার ড্যাম এলাকা পর্যন্ত হালদা নদীর বিভিন্ন স্থানে নানান বর্জ্যে ভরা। নাজিরহাট বাজারের পশ্চিম পাশে হালদা পাড়ে গরু জবাইয়ের পর বর্জ্য, মুরগীর ফার্মের বর্জ্যসহ বাজারের সব ময়লা–আবর্জনা ফেলা হচ্ছে হালদায়। বাজারের পশ্চিম পাশে মাছ বাজারের ময়লা, কাঁচাবাজারের ময়লার নিরাপদ স্থান হচ্ছে হালদার পাড়।

এসব আবর্জনা পচে জোয়ারের সময় হালদার পানির সঙ্গে মিশে নদীর স্বচ্ছ পানিকে করছে বিষাক্ত। ভুজপুর রাবার ড্যাম এলাকায় গড়ে উঠা রেস্টুরেন্টের বর্জ্য সরাসরি হালদা নদীতে ফেলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দখলকারীদের নৃশংসতা। বাঁশের দোকান, লাকড়ির দোকান, গাছের টুকরা মজুদসহ নানা অজুহাতে দিন দিন হালদাকে গ্রাস করছে ক্ষমতাসীন দলের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। ফলে দ্রুত কমে আসছে হালদার প্রশস্ততা। হালদার পাড়ে এক সময় মানুষ বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নিতে ছুটে যেতো। এখন সেখানে দখল আর দূষণের ভরপুর। নাজিরহাট বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারে ময়লা ফেলার নির্ধারিত ডাস্টবিন না থাকায় ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েই হালদায় ময়লা বা বর্জ্য ফেলছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হালদা বিশেষজ্ঞ মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদায় যেহেতু জোয়ার–ভাটা আছে, সেজন্য নদীর উপরিভাগে কোন বর্জ্য বা ময়লা পড়লে তা পুরো নদীর পানিকেই বিষাক্ত করে তোলে। এছাড়া চট্টগ্রামের ৭০ লাখ বসবাসকারীর সুপেয় পানির একমাত্র ভরসা হালদা নদী। হালদায় বর্জ্য ফেলা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রামের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া হালদায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিলুপ্তিসহ পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাব্বির রহমান সানি বলেন, প্রাকৃতিক মৎস প্রজননক্ষত্রটি আমাদের সম্পদ। এটি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এই নদী চট্টগ্রামের সম্পদে পরিণত হবে। নগরীর একটি খাল উন্্মুক্ত করে দিলেই হালদার বিদ্যমান দূষণের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যাবে।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু বৈশিষ্টের কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী। এটি রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি) দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। এখান থেকে সরাসরি মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।

যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু নানামুখী দূষণ এবং কৃত্রিম নানা আয়োজনে হালদায় মা মাছের স্বাভাবিক চলাচল এবং ডিম ছাড়ার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখে পড়ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেও দায়ী করা হয়।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, রামগড়ের পাতাছড়া ইউনিয়ন থেকে শুরু হওয়া হালদা নদী নানা বাঁক পেরিয়ে ১২৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কর্ণফুলী নদীতে এসে মিশেছে। এই দীর্ঘ পথে উভয় পাড়ে ফসলে, ফলনে হালদার ভূমিকা ছিল অনন্য। হালদা শুধু মাছই নয়, ফলনেও পুরো জনপদকে সমৃদ্ধ করেছিল।

কিন্তু বিগত একশ বছরে হালদার এগারটি বাঁক কেটে সোজা করা হয়েছে। নৌ চলাচলের সুবিধার জন্য এটা করা হলেও হালদা প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের সর্বনাশ করা হয়েছে। ১১টি বাঁক কেটে হালদার দৈর্ঘ কমানো হয়েছে ২৫ কিলোমিটার। বর্তমানে হালদা নদীর দৈর্ঘ ৯৮ কিলোমিটার। বাঁকগুলো সোজা করার কারণেই মূলত হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্রগুলোর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে।

বর্তমানে নাপিতের ঘোনা, হরেকৃঞ্চ মহাজন টেক ও কেরামতলীর বাঁকের অস্তিত্ব রয়েছে; যেখানে মা মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁক সোজা করা না হলে হালদায় মা মাছের আনাগোনা এবং ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো বেশি থাকত। শুধু মৎস্য প্রজনন নয়, হালদার বাণিজ্যিক গুরুত্বও কমে গেছে। এক সময় চাক্তাই থেকে বড় বড় নৌকা বোঝাই করে পণ্য সামগ্রী ফটিকছড়ির নারায়ণহাট পর্যন্ত চলাচল করত। নাজিরহাট, ফটিকছড়িসহ উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকার প্রয়োজনীয় নানা পণ্য চাক্তাই থেকে নৌকাযোগে হালদা হয়ে গন্তব্যে যেত।

নাজিরহাট ব্রিজের নিচে বিশাল বিশাল নৌকা ও ট্রলারের বহর অপেক্ষা করত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। একই সাথে হারিয়েছে নৌ-বাণিজ্যের রুটও। বর্তমানে চাক্তাই থেকে মেখল বা ছিপাতলী পর্যন্ত নৌকা চলাচলের সুযোগ রয়েছে। এর উপরে আর নৌকা যাতায়াত করতে পারে না।

হালদা নদীর প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে বাঁক কেটে দেওয়া, নির্বিচারে মা মাছ নিধন, হালদার দুই পাড়ে তামাক চাষ, একটি কাগজ কল ও একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ এবং নগরীর ময়লা-আবর্জনার প্রবাহ অন্যতম। এর মধ্যে সরকারি নানা উদ্যোগে বেশ কিছু সংকটের সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে মানিকছড়িতে এখন আর তামাক চাষ হয় না। দেড়শ তামাক চাষির সকলকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে মূল চাষাবাদে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এখন হালদাপাড়ে মাছের জন্য ক্ষতিকর কোনো বিষাক্ত চাষাবাদ নেই। হালদা থেকে মা মাছ নিধনও প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অনেক বেশি সচেতন। সকলের সম্মিলিত নজরদারিতে হালদা এখন অনেক বেশি নিরাপদ।
হালদা পাড়ের যে দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দূষণের জন্য দায়ী করা হয়েছিল সেগুলো বন্ধ রয়েছে। এতে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য আর নদী দূষণ করছে না। তবে নতুন আপদ হিসেবে নগরীর বর্জ্যই এখন হালদা দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।

নগরীর বর্জ্য সরাসরি গিয়ে হালদা নদী দূষণ করছে। বিশেষ করে বামনশাহী খাল হয়ে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা আগে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ত। এখন তা হালদায় গিয়ে পড়ছে। অনন্যা আবাসিক এলাকার সন্নিকটে একটি বাঁধ কেটে বামনশাহী খাল উন্মুক্ত করে দিলে হালদায় শহরের ময়লা যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা নদী গবেষণা ল্যাবরেটরির সমন্বয় এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, বামনশাহী খাল থেকে হালদাকে রক্ষা করা গেলে এর দূষণ একেবারে কমে যাবে। নদী ফিরে পাবে স্বাভাবিকতা। এতে হালদার হারিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে আসতে শুরু করবে। তিনি বলেন, দূষিত হয়ে যাওয়া নদীকে সুস্থ করে তোলার বৈশ্বিক উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের টেমসের নাম বলা হয়। বামনশাহী খালের ময়লা-আবর্জনা বন্ধ হলে আমরা টেমসের পরিবর্তে হালদার নাম বলতে পারব।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার বলেন, হালদা দেশের জাতীয় সম্পদ। তাই সরকার এই নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করেছেন। এই নদীর মাছ, জীব বৈচিত্র্য, ডলফিন ও নদী দূষণ রক্ষা করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। এজন্য সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে এসে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন