৯ নভেম্বর ২০২৫

হৃদরোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

বাংলাধারা ডেস্ক »

বিশ্ব হার্ট দিবস আজ বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর)। দিবসটি উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট’। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালন করা হচ্ছে।

বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ন্যাশানাল হার্ট ফাউন্ডেশন দিবসটি পালন করছে।

গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯- এর তথ্য মতে,প্রতি দুই মিনিটে দেশে একজন মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। আর প্রতি ঘণ্টায় মারা যায় প্রায় ৩২ জন মানুষ। একদিনে এর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৬৯ জনে। যার সংখ্যা মাসে ২৩ হাজার ৮৩। হিসেব অনুযায়ী প্রতিবছর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ, যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক। তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়।

আজ আমরা হৃদরোগের আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করবো,জানা যাক হৃদরোগ কী, এর প্রকার, কারণ, লক্ষণ, সুস্থ থাকার উপায় বা প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং হৃদরোগের চিকিৎসা।

হৃদরোগ কি জানার আগে আমরা জানবো হার্ট বা হৃৎপিণ্ড কী?
যে অঙ্গটি পাম্পের মতো সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে সারাদেহে রক্ত সংবহন করে সেটি হলো হৃদপিন্ড । জীবন্ত এ পাম্প যন্ত্রটি দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে আনীত রক্ত ধমনীর সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করে থাকে । একজন সুস্থ মানুষের জীবদ্দশায় হৃদপিন্ড গড়ে ২৬০০ মিলিয়ন বার স্পন্দিত হয় । একটি হৃদপিন্ডের ওজন প্রায় ৩০০ গ্রাম । নারীদের তা পুরুষের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম ।

হৃদরোগ কী
হৃদরোগ বলতে সাধারনভাবে হৃৎপিন্ড, রক্তবাহী ধমনী ও শিরা, মস্তিষ্ক ও বৃক্ক সম্পর্কিত রোগকে বোঝায়। হৃদরোগের অনেক কারণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও অ্যাথেরোসক্লোরোসিস প্রধান। বয়সের সঙ্গে হৃৎপিন্ড ও ধমনীর গঠনগত পরিবর্তনও হৃদরোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী। হৃদরোগ সাধারনত বয়স্কদেরই হয়। মহিলাদের চেয়ে পুরুষরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে এবং যার অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে ১৯ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন।

হৃদরোগের প্রকার
হৃদরোগ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন- জন্মগত হৃদরোগ, করোনারি হৃদরোগ, হার্ট ফেইলর, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, উচ্চ রক্তচাপ জনিত হৃদরোগ, কোর পালমোনাল (হৃৎপিণ্ডের ডান পাশ অচল হয়ে যায় এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়), সেরেব্রোভাস্কুলার রোগ (মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী রক্তবাহিকার অসুখ, যেমন- স্ট্রোক), প্রান্তিক ধমনীর রোগ, রিউম্যাটিক হৃদরোগ (বাতজ্বরের কারণে হৃদপেশি ও ভাল্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া), কার্ডিয়াক ডিসরিদ্মিয়াস ইত্যাদি।

এবার জেনে নি হৃদরোগের ১০টি কারণ
– বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
– মহিলাদের চেয়ে পুরুষেরা হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে মেনোপজের পরে মহিলাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
– অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
– বাবা-মায়ের হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অধিক থাকে। এর মূল কারণ পরিবারের একই খাদ্যাভ্যাস ও ধূমপানের অভ্যাস।
– উচ্চ রক্তচাপ করোনারি হৃদরোগের একটি মারাত্মক রিস্ক ফ্যাক্টর। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিন্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
– রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রার আধিক্য হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর।
– হৃদরোগ হওয়ার পেছনে ডায়াবেটিসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
– অধিক ওজন হলে শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃদপিণ্ডের অধিক কাজ করতে হয়। যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
– শারীরিকভবে নিস্ক্রিয় লোকদের হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অলস জীবন-যাপন করোনারি হৃদরোগের জন্য আরেকটি রিস্ক ফ্যাক্টর।
– হৃদরোগ হওয়ার পেছনে ধূমপানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি নিয়মিত ধূমপান করে থাকেন তার হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি থাকে।

হৃদরোগের লক্ষণসমূহ
হৃদরোগে বুক ব্যথা সাধারণত বুকের মাঝখানে হয়ে থাকে। কখনও বুকের বামপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়েও তা হতে পারে। এই ব্যথা মৃদু থকে তীব্র, বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সাধারণত একটা তীব্র চাপ এই ব্যথার বৈশিষ্ট্য। অনেকের ব্যথা শুধু বুকের মধ্যখানে অথবা বুকে হৃদপিন্ডের উপর সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। যদিও এই ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা বুকে, বাম কাঁধে, বাম বাহুতে, বাম হাতে, বাম কড়ে আঙ্গুলে।

কখনও কখনও ডান কাঁধেও এ ব্যথা আসতে পারে। আবার এই ব্যথা গলা দিয়ে চোয়াল পর্যন্তও চলে আসে। কেউ কেউ এ ব্যথা উপরের পেটেও অনুভব করেন। এনজাইমা হলে সাধারণত পরিশ্রমের পর রোগী এই ব্যথা অনুভব করেন এবং বিশ্রাম করলে এই ব্যথা চলে যায়। কিন্তু একবার মাইওকার্ডিক্যাল ইনফ্রাকশন হলে এ ব্যথা এবং চাপ চলতে থাকে। তখন বুকে ব্যথার সঙ্গে প্রায়ই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, শরীর ঘামতে থাকে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং কখনও কখনও বুক ধড়ফড় করে।

কোন কোন রোগী অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যান। ব্যথার সময় গ্লিসারিন ট্রাই নাইট্রেট (জিহ্বার নিচে দিয়ে চুষতে হয় অথবা জিহ্বার নিচে স্প্রে করতে হয়) ওষুধে ২ মিনিটে যদি ব্যথা না কমে, দম বন্ধ ভাব, দারুণ দুর্বলতা অথবা বুকে চাপ চলতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে পরিস্থিতি মোটামুটি গুরুতর পর্যায়ে। সুতরাং হাসপাতালে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।

যারা অতি বৃদ্ধ, যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অথবা যারা অধিক মদ্যপায়ী তাদের বুকে ব্যথা ছাড়াও মাইওকার্ডিক্যাল ইনফ্রাকশন হতে পারে। ওই ধরনের রোগীরা দারুন দুর্বলতা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অথবা হৃদপিন্ড ঢিলে হয়ে যাওয়ার দরুন, হাত-পা ফুলে গিয়ে অসুবিধার দরুন ডাক্তারের কাছে আসতে পারেন।

সুস্থ থাকার উপায় বা প্রতিরোধ
হৃদরোগ অনেকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। হৃদরোগ চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ সহজ। এ জন্য দরকার রোগ সম্পর্কে ধারণা এবং প্রতিরোধের ইচ্ছা।

করোনারী হৃদরোগের কারণ সঠিক জানা যায়নি। তবে রক্তে চর্বির আধিক্য, ধূমপান, হাইপারটেনশন এবং ডায়াবেটিকস করোনারী ডিজিজ (হার্ট এ্যাটাক) এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং এগুলো প্রধান ঝুঁকি বা রিসক ফ্যাক্টর। এগুলো যে শুধু হার্ট এ্যাটাকই করে তাই নয়, শরীরের যে কোনো রক্ত নালীতে চর্বির প্রলেপ জমিয়ে আরও ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করে যেমন- স্ট্রোক, পায়ের গ্যাংরিন, কিডনির রোগ ইত্যাদি। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এই সমস্ত রোগের ঝুঁকিও কমানো যায়।

প্রতিকার
হৃদরোগ থেকে বাঁচতে হলে এর প্রতিকার সম্পর্কে জানা জরুরি, এবার জেনে নিন, কী করে হৃদরোগের প্রতিকার করা সম্ভব।

– হৃদরোগের শত্রু হচ্ছে ধূমপান। তাই ধূমপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।
– ধূমপানের মতো মাদকও হৃদরোগের আরেকটি কারণ, তাই মাদককে না বলুন।
– অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। ভালো থাকবেন।
– মাঝে মাঝে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। শরীরের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন।
– ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। নিয়মিত হাঁটা-চলা ও ব্যায়াম করে নিজেকে সুস্থ রাখুন।
– প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি খান।

হৃদরোগের চিকিৎসা
বুকের ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, ঘাম দিয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে। এমআই হলে সাধারণত করোনারি ধমনীর কোন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়। আজকাল রোগী যদি ব্যথা শুরু হওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে হার্টের ইউনিটে পৌঁছতে পারেন তাহলে ওই জমাট রক্ত তরল করে ফেলার জন্য বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এমআই হবার প্রথম ঘণ্টাকে এজন্য গোল্ডেন আওয়ার বলে।

এছাড়া ব্যথা, অস্থিরতা, অক্সিজেনের অভাব ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ওষুধ এবং অক্সিজেন দিয়ে রোগীকে আরাম দেয়া হয়।

একই সঙ্গে রোগীর হাইপ্রেসার বা ডায়াবেটিস থাকলে তা চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অল্প কিছুদিন পূর্ণ বিশ্রাম করার পর হালকা কাজের মাধ্যমে ধীরে ধীরে রোগীকে পুনর্বাসিত করতে হয়।

ভবিষ্যতের জন্য লাইফ স্টাইল পরবর্তিত করে নিতে হয়। ধূমপান করলে করোনারি রক্তনালি চেপে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়। এ জন্য ধূমপান এ রোগীর চরম শত্রু।

কোলেস্টরল এবং লিপিড নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সাধারণত ভাত এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য কম খেতে হয়। কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণের জন্য ফুলক্রিম দুধ, সর, ঘি, মাখন, চর্বি, ডিমের কুসুম, মগজ, কলিজা, হাড়ের ভেতরের নরম অংশ, গরু, খাসি, শর্করা, মদ ইত্যাদি খাদ্য শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রক্তের চর্বি এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধও পাওয়া যায়।

সাধারণত ফল, শাক-সব্জি, মাছ, ডাল লিপিড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেসার রোগের ক্ষেত্রে লিপিড এবং ধূমপান নিয়ন্ত্রণ এবং শক্ত হাতে চিকিৎসা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

অ্যাটাক থেকে ভালো হওয়ার পর চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারিত ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করোনারি রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। একমাত্র চিকিৎসক রোগীর সবকিছু বিবেচনা করে কোন ধরনের ব্যায়াম তিনি গ্রহণ করতে পারবেন তা নির্ধারণ করবেন।

তথ্যসূত্র : ‘রোগ চিনতে চান’ গ্রন্থ। অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

বাংলাধারা/এসআরটি

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ