২৩ অক্টোবর ২০২৫

৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তালাবাত কর্মীর না বলা কথা

সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)—বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ, উন্নত ও মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা তেলসমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্র। চমৎকার অবকাঠামো, কঠোর আইনশৃঙ্খলা ও প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য দেশটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তবে এই আধুনিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক কঠিন বাস্তবতা—প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামী জীবন।

এমনই একজন সংগ্রামী প্রবাসী বাংলাদেশি হচ্ছেন সুমন আহমেদ, যিনি লক্ষ্মীপুর জেলার, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সন্তান। অল্প বয়সেই পরিবার-পরিজন ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, স্বপ্ন পূরণের আশায়।

প্রবাসজীবনের শুরু ও পথচলা

প্রথমে সুমন কাজ শুরু করেন আবুধাবির সুপরিচিত আঞ্জুমান রেস্টুরেন্টে। পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে সেখান থেকেই সংগ্রহ করেন মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স, যা এই দেশে অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। সদালাপী ও মিষ্টভাষী সুমনের সাথে পরিচিত হয়েই এক বন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তালাবাত কোম্পানির সঙ্গে। আলোচনার মাধ্যমেই তিনি পেয়ে যান ডেলিভারিম্যানের চাকরি।

অগ্নিঝরা গ্রীষ্মের মধ্যেও অবিরাম ছুটে চলা

বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গ্রীষ্মকাল। মরুভূমির উত্তাপে তাপমাত্রা কখনো কখনো ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে যায়। রাস্তায় যেন আগুন ঝরে পড়ছে, গরম বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই অসহনীয় পরিবেশেও থেমে নেই সুমনের মতো হাজারো ডেলিভারিম্যানের পথচলা।

সুমনের দিন শুরু হয় বাইকে চড়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খাবার, ওষুধ, অনলাইন অর্ডার করা পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এক ডেলিভারি শেষ না হতেই পরেরটার জন্য ছুটে চলা। বাইকের সিট যেন আগুনের মতো গরম, হেলমেটের ভিতর ঘাম জমে যায়, কিন্তু কাজ থেমে থাকে না।

না বলা কথাগুলো

সুমনের চোখে দেখা সেই বাস্তবতা এবং তার অনুভবের প্রতিফলন হয়তো এমন হতে পারে:

“যখন বাইক নিয়ে রাস্তায় বের হই, মনে হয় যেন চুল্লির ভেতরে ঢুকেছি। গরম বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু উপায় নেই—কাজ তো করতেই হবে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।”

“অনেক সময় শরীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে আর চালাতে ইচ্ছা করে না। হাত-পা ব্যথা করে, মাথা ঘোরে। একটু বসে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও পাওয়া যায় না। প্রতিটি ডেলিভারিই যেন পরিবারের জন্য নতুন একটা আশার আলো।”

“দেশের কথা খুব মনে পড়ে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান—সবাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দূর থেকেও তাদের জন্য কিছু করতে পারলে এই কষ্টগুলো সার্থক মনে হয়।”

“গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেলে খুব ভালো লাগে। কারও একটুখানি হাসি বা ধন্যবাদ যেন সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।”

“স্বপ্ন দেখি—একদিন সব কষ্ট শেষ হবে। একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে, পরিবারকে কাছে পাবো। একসাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করব। সেই স্বপ্ন নিয়েই প্রতিদিন গরমের সঙ্গে যুদ্ধ করি।”

সব প্রবাসীর কণ্ঠস্বর

সুমনের এই না বলা কথাগুলো শুধু তার একার নয়, বরং হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের প্রতিচ্ছবি। তারা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস।

কিন্তু তাদের এই পরিশ্রমের স্বীকৃতি কি আমরা যথাযথভাবে দিচ্ছি? সুমনদের কষ্ট ও ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে যদি আমরা একটু সহানুভূতিশীল হই, তাদের কথা বলি, তবে হয়তো তাদের জীবনযুদ্ধে কিছুটা সাহস যোগ হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের উত্তপ্ত রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে প্রতিদিন যারা শহরের অলিগলিতে সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন—তাদের একজন সুমন। তার না বলা কথাগুলো আজ আমরা বললাম। হয়তো এটুকুই তার প্রাপ্য সম্মান নয়, তবে এটিই হতে পারে একটুখানি স্বীকৃতির সূচনা।

আরও পড়ুন