৯ নভেম্বর ২০২৫

৭০ লাখ মানুষের বর্জ্যে শ্বাস বন্ধের উপক্রম কর্ণফুলীর

হাসান সৈকত »

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নদীর তালিকায় সবার উপরে কর্ণফুলী। নদীটি তার উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ১০৯ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের সিমানায় প্রবেশ করেছে। এর বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্ত ৪৫৩ মিটার। এছাড়া এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীও বটে।

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে দখল ও দূষণের হার। নদীর দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কলকারখানা ছাড়াও ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট। যা সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম নগরীতে বসবাস করা প্রায় ৭০ লাখ মানুষের বর্জ্য এবং ভূমি দস্যুদের দখলের কবলে পড়ে নদীটি এখন পঙ্গুর পথে।

সূত্রে জানা গেছে, ১৬১ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে কালুরঘাট থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত এলাকায়। বাংলাবাজার থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। এই তিন কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ১৪০ টি জেটি ও ঘাট। নদীর দুই অংশে নানান স্থাপনা গড়ে ওঠায় জাহাজ চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে কর্ণফুলী চ্যানেলও।

জানা গেছে, কর্ণফুলীর দূষণরোধ, নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন করতে গত পাঁচ বছরে চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর্ণফুলী রক্ষায় নানান নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট।

কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা কে মানে? ভূমি দস্যুরা এখন আরও বেশি ব্যস্ত দখল-দূষণে। কার আগে কে দখল করবে তা নিয়ে হৈ-রৈ কাণ্ড। তাছাড়া, দখল নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া তো এখন নিত্যদিনের ব্যাপার।

সরেজমিনে দেখা যায়, দুই ধারে গড়ে ওঠা কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য সরাসরি নদীতেই পড়ছে। এসব বর্জ্যে মিশে আছে বিভিন্ন ক্ষতিকর ক্যামিকেল যা নদীর পানিকে দূষিত করছে।

এছাড়া, চট্টগ্রাম নগরীর সবকটি খাল ও নালার শেষ সংযোগস্থল কর্ণফুলী নদী। এসব নালা ও খালের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নগরে বসবাসকারী ৭০ লাখ মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিক-পলিথিন ছাড়াও সব ধরনের ময়লা আবর্জনা গিয়ে পড়ছে নদীতে। এর ফলে নদীর তলদেশে জমা হচ্ছে ক্রমিয়াম, নিকেল, সিসা, তামা ও দস্তার মতো ভারি ধাতু। যা নদী দূষণ, গভীরতরা হ্রাস এবং ভরাটের অন্যতম কারণ।

সম্প্রতি একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের জরিপে দেখা যায়, চাকতাই খালের মোহনার উত্তর পাশের গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ১৩ ফুট এবং দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় নদীর তীরবর্তী গভীরতা পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ৭ ফুট।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৮৯টি উৎস ও ৩০টি কারণ কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য দায়ী। এর মধ্যে ৫৩টি শিল্প কারখানা,  ১৪টি জাহাজ মেরামতের জায়গাসহ বাজার, নালা, খামার ও শুটকি পল্লী অন্তর্ভুক্ত।

গবেষণায় দেখা যায়, নদীর দুই পাড়ের প্রায় ৮১টি প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে এবং ৬১ প্রজাতি ইতোমধ্যে বিপন্ন। এমনকি দূষণ রোধ ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হতে পারে।

কোনো এক সময় কর্ণফুলী নদীতে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যেত ডলফিনের সমারোহ। কিন্তু সেই ডলফিন এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে।  গবেষণায় বলা হয়েছে, দ্রুত দূষণ ঠেকানো না গেলে বিলুপ্ত হয়ে পড়বে ডলফিনসহ আর ও নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরে প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ২৪৯ টন বর্জ্যই পলিথিন-প্লাস্টিক জাতীয়, যা গিয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। নদীতে থাকা বিভিন্ন স্তরের মাছ এই পলিথিন জাতীয় বর্জ্যগুলোকে নিজেদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আবার এসব মাছ মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করায় মানবদেহে মিশে যাচ্ছে ক্ষতিকর ক্যামিকেল ও মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

বাংলাধারা/এআই

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ