সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
আষাঢ়ের শেষ বর্ষণে কক্সবাজার জেলা শহর ও বিভিন্ন উপকূলের সমতল এলাকায় জলজটে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন অধিবাসীরা। বর্ষণের পাশাপাশি সাগরের পানি বাড়িয়েছে লঘুচাপ। ফলে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে কিছু কিছু এলাকা। টানা দেড় সপ্তাহের বর্ষনে দুর্ভোগে পড়েছেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ।
পানিবন্দি হয়ে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছেন চকরিয়া-পেকুয়ার লাখো মানুষ। গত ৪ জুলাই বর্ষন শুরুর পর থেকে এখানে পাহাড় ধ্বস ও বানের জলে ভেসে এবং বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে স্বামী-স্ত্রীসহ মারাগেছেন ৫ জন। নদীর ভাঙ্গনে ঘর-বাড়ি হারিয়েছে বেশ কিছু পরিবার। এদের মাঝে সহায় সম্ভবহীন পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট।
সূত্রমতে, গত ৪ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত সময়ে কক্সবাজারে গড় বৃষ্টিপাত এক হাজার ৪০ মিলিমিটার। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অব্যহত রয়েছে। এভাবে আরো কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পাহাড় ধ্বসের আশংকা রয়েছে খুব। এমনই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় বসতি করা হাজারো পরিবার।
ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওদের সমন্বয়কারি সংস্থা আইএসসিজি তথ্য মতে, ৪ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১ হাজার ৪০ মিলিমিটার। এর মধ্যে, উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী আবাসনের বিভিন্ন অংশে বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ৭০৯ মিলিমিটার। ভূমিধ্বস, জলজট এবং দমকা বাতাসে শত-শত স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিনষ্ট হওয়ায় হাজার-হাজার শরণার্থী সাময়িক ভাবে বাস্তু-চ্যুত হয়েছেন। একটি হিসাব মতে প্রায় ১১ লাখ শরণার্থীর আনুমানিক ৫ শতাংশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটি মোট জনসংখ্যার একটি ছোট অংশ মনে হলেও, ইতোমধ্যে সহায়-সম্বলহীন হয়ে যাওয়া শরণার্থীদের ওপর এর গুরুতর প্রভাব পড়েছে।

বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ভেসে গেছে উখিয়াসহ উপকূলের নদী সংলগ্ন হাজার হাজার একর চিংড়ি ঘের। বৃষ্টির পানি নিস্কাশনে সরল পথ না থাকায় গ্রামের শত শত বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেছে। অপরিকল্পিত দোকানপাট, স্থাপনা, ভাড়া বাসা তৈরির ফলে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালী, থাইংখালী, কোটবাজারসহ অনেক এলাকায় পানিবন্দির কারনে যানবাহন চলাচল ব্যহত হচ্ছে। একই অবস্থা কুতুবদিয়া, রামু, সদরের ঈদগাঁও এবং টেকনাফের কিছু কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চলেও।
শুধু গ্রাম নয়, অব্যাহত বৃষ্টি হলেই কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়া, নুরপাড়া, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, রুমালিয়ারছড়া, আলিরজাহাল, তারাবনিয়ারছড়া, বার্মিজ মার্কেট, কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের উপর হাটুপরিমাণ কাঁদাপানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন পৌরবাসী ও পর্যটকরা।
এদিকে, ভারী বর্ষণের ফলে চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীতে তীব্র বেগে ঢল নেমেছে। নদীতে জোয়ারের পানি বাড়ন্ত থাকায় সমতলে জমে রয়েছে বৃষ্টির পানি। ফলে পানিবন্দি রয়েছে চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল, কোনাখালী, বিএমচর, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, ফাঁসিয়াখালী ও পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা এবং পেকুয়া সদর, উজানটিয়া, মগনামা, বারবাকিয়া, শিলখালীসহ বর্তমানে বেশ ক’টি ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। ঢলের পানিতে বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি চরম সংকটে।

সড়ক উপচে চলা ঢলের পানি পার হতে গিয়ে পানিতে নিখোঁজ হয়ে মারা গেছেন মোহাম্মদ রাজু (২৫) নামে এক যুবক। তিনি চকরিয়ার ভেওলা মানিকচর ইউনিয়নের (৭নং ওয়ার্ড) দিয়ারচর এলাকার মোঃ জামাল উদ্দিনের ছেলে। ১৪ জুলাই ভেসে যাওয়া রাজুর মরদেহ একদিন পর সোমবার বিকেলে উদ্ধার হয়।
অপরদিকে, সোমবার (৮ জুলাই) ভোররাতে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ের ৮নম্বর ওয়ার্ডের হাফালিয়া কাটা এলাকায় বসতঘরের মাটির দেয়াল ধসে পড়ে মুহাম্মদ হারুনুর রশিদ হারুন (৩৫) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। হারুন ওই এলাকার মৃত বশির আহমদের ছেলে। অতিবৃষ্টিতে দেয়াল ধ্বসের এ ঘটনা ঘটে বলে জানান, বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার।
আবার, রোববার (১৪ জুলাই) ভোররাতে চকরিয়ার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বমুরকুল এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনায় মো. আনোয়ার সাদেক (৩৫) ও তার স্ত্রী ওয়ারেসা বেগম (৩০) মারাযান। অতিবৃষ্টির ফলে পাহাড় ধ্বসে ঘরের উপর পড়লে ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হয় বলে জানান, বমুবিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মতলব।
একই উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের উত্তর মানিকপুর ২নং ওয়ার্ডে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি থেকে সরতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহম্মদ হোসেন (৭৫) নামের এক বৃদ্ধ মারা যান। রোববার (১৪ জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার দিকে মারা যাওয়া আহম্মদ হোসেন ওই এলাকার মৃত আবদুল হামিদের ছেলে বলে জানিয়েছেন সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম। বর্ষণ ও ঢলের পানি বাড়িতে উঠলে পরিবারের লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরাতে যাবার সময় তিনি বিদ্যুত স্পৃষ্ট হয়ে মারাযান।
দেড় সপ্তাহের টানা বৃষ্টি ও মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে চকরিয়া ও পেকুয়ার নলকূপ, কৃষিক্ষেত ও আউশ চাষের বীজতলা। মাতামুহুরি নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি। নৌকা বা বাঁশের ভেলায় নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা চালাচ্ছেন জলবন্দিরা।

দুই উপজেলায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে প্রায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। চকরিয়ার বরইতলী, কাকারা, সুরাজপুর মানিকপুর, ডুলাহাজারা, হারবাং, পহরচাঁদা, বিএমচর, লক্ষ্যারচর ও শাহারবিল ইউনিয়ন, পেকুয়া উপজেলার সদর, শীলখালী, বারবাকিয়া, টইটং, মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ। প্লাবিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট।
কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমানের মতে, বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বন্যার পানি কমেনি। প্লাবিত পরিবারে রান্না বন্ধ রয়েছে। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে সরবরাহ করা খিঁচুড়ি ও শুকনো খাবার পর্যাপ্ত নয়।
মাতামুহুরী নদীর স্রোতে তলিয়ে নিয়েছে চকরিয়ার বিএম চর ইউনিয়নের ছোট ভেওলা পাড়ার নিজাম উদ্দিনদের (২৮) বসতঘর। পরিবারের ঘুমন্ত সদস্যদের ডেকে তুলে কোনমতে সবার প্রাণরক্ষা করা গেলেও অধিকাংশ আসবাবপত্র এবং প্রয়োজনীয় সব পণ্য কয়েক মুহূর্তেই মাতামুহুরি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কোন জমিজমা না থাকার বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্কুল পড়ুয়া ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইহীন হয়ে পড়েছেন তারা। সোমবার ভোররাতে তারা এ দূর্ভোগের মুখোমখী হয়।
নিজাম উদ্দিনের বাবা দলিলুর রহমান (৭৭) বলেন, ১৯৯১সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে এ ঘরটি তুলেছিলাম। আমাদের আশেপাশে আরো দেড় শতাধিক বাসিন্দা ছিল তখন। কিন্তু কালক্রমে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে আর বেশি ঘর অবশিষ্ট নেই এ পাড়ায়। গত পাঁচদিনে একই গ্রামে বিলীন হয়েছে আরো অন্তত দশটি ঘর। আগে ছিলাম কৈয়ারবিল ইউনিয়নের বাসিন্দা। কিন্তু নদীর ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় আমরা এখন বিএম চর ইউনিয়নের বাসিন্দা। পাড়ার যারা সচ্ছল ছিলেন তারা অন্যত্র জমি কিনে ঘর তুলেছে। কিন্তু আমরা গরীব মানুষ। সে সক্ষমতা আমাদের নেই। ২০শতক জমি ছিল আমার। কিন্তু তা ভাঙ্গনের কবলে পড়ে এখন নদীর চরে পরিণত হয়েছে। যা বর্তমানে পানির নিচে ডুবে আছে৷ শুষ্ক মৌসুমে এ জমিতে চাষাবাদ করে কিছু উপার্জন করা যায়। একমাত্র ছেলের আয়ে সাত জনের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায়। তাই নদীর চরেই পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মাতামুহুরি নদীর পাহাড়ি ঢলের পানিতে গত পাঁচদিনে চকরিয়া উপজেলার বিএম চর, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে বিলীন হয়েছে আরো অন্তত ২৫টি ঘর। গৃহহীন এসব মানুষ এ বৈরী আবহাওয়ায় এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। বানের পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে এসব এলাকায়।
বিএম চর ইউপির সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানির ধাক্কায় নদীর তীর ভেঙ্গে নয়াখাল ও ছোট ভেওলা পাড়ার এলাকার নদীর তীরের ১০টি বসতবাড়ি মাতামুহুরী নদীতে বিলীন হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, বন্যায় বেতুয়া বাজার ও ইরল্যারকুমের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বন্যার পানি কমে না যাওয়া পর্যন্ত দুর্গতদের শুকনো খাবারের পাশাপাশি চাল ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেয়া হবে।
পেকুয়ার ইউএনও মাহাবুবউল করিম বলেন, পেকুয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পানি আরো বাড়বে। মেহেরনামার ঢলের পানিতে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধটি সংস্কার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ মেট্রিক টন চাল ও ৫শ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
চকরিয়া ইউএনও নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, অতিবর্ষণের ফলে বন্যার পানি নামতে পারেনি। পানিবন্দী রয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা এখন বিতরণ করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, বসতঘর বিলীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। শীঘ্রই তাদেরকে সরকারী সহয়তা দেয়া হবে।
বাংলাধারা/এফএস/এমআর













