আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, ক্যাম্পে সেভেন মার্ডার ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং হত্যা, অস্ত্র, অপহরণসহ ২১ মামলার আসামী শহিদুল ইসলাম ওরফে মৌলভী অলি আকিজকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫। এসময় তার আরো চার সদস্য গ্রেফতার হয়েছেন। রবিবার (৯ জুন) রাতে উখিয়ার ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে র্যাব-১৫ তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছেন র্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সালাম চৌধুরী। এসময় দেশী-বিদেশী অস্ত্র, কার্তুজ-গুলি এবং বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-৫, ব্লক-সি’র বাসিন্দা মৃত আবুল বাশার ওরফে মৌলভী নাছেরের ছেলে শহিদুল ইসলাম ওরফে মৌলভী অলি আকিজ (৫০), ক্যাম্প-৬, ব্লক-ডি’র মৌলভী আনোয়ারের ছেলে ফয়সাল ওরফে মাস্টার ফয়সেল (২৮), ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশন, এস/৪, বি/৫’র মৃত মৌলভী রহমত উল্ল্যার ছেলে হাফেজ ফয়জুর রহমান (২৪), বালুখালী ক্যাম্প-৮/ই, ব্লক-বি/৪৪’র মৃত করিম উল্ল্যার ছেলে মো. সালাম ওরফে মাস্টার সালাম (২০) এবং টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্প-২২’র আনু মিয়ার ছেলে মো. জুবায়ের (২৪)।
র্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সালাম চৌধুরী জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মে জড়িত পড়ছে আরসা। সকল সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্মূলে র্যাব-১৫, কক্সবাজার বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারী চালু রাখে। অভিযানে আরসার সামরিক কমান্ডার হাফেজ নূর মোহাম্মদ, অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুস, গান কমান্ডার রহিমুল্লাহ @ মুছা, অর্থ সমন্বয়ক মোহাম্মদ এরশাদ নোমান চৌধুরী ও আবু তৈয়ব, কিলার গ্রুপের প্রধান নূর কামাল সমিউদ্দিন, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডার ওসমান গনি র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এছাড়াও লজিস্টিক শাখার প্রধান, গান গ্রুপের প্রধান, প্রধান সমন্বয়ক, অর্থ শাখার প্রধান এবং আরসা প্রধান নেতা আতাউল্লাহর দেহরক্ষী আকিজসহ সর্বমোট ১১২ জন আরসা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ হতে ৫১ দশমিক ৭১ কেজি বিস্ফোরক, ৫টি গ্রেনেড, ৩টি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় তৈরী হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৪টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১৬৮ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ৪টি আইডি ও ৪৮টি ককটেল উদ্ধার করা হয়।
শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার এবং তাদের কাছ থেকে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ফলে আরসা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিস্ক্রিয় বা নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসহ হত্যাকান্ডের ঘটনা পূর্বের তুলনায় অনেকাংশেই হ্রাস পেলেও বিগত কিছুদিন ধরে পুনরায় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে গত মে মাস থেকে অদ্যাবধি ১১টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। হঠাৎ হত্যাকান্ড বেড়ে যাওয়ায় র্যাব-১৫ এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে।
এরই প্রেক্ষিতে আরসার শীর্ষ নেতা মৌলভী অলি ওরফে আকিজ দীর্ঘদিন পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে থেকে আরসার শীর্ষ কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের নির্দেশনাক্রমে ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এই তথ্যের সূত্র ধরে মৌলভী আকিজসহ তার সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য র্যাব-১৫ এর আভিযানিক দল তৎপরতা বৃদ্ধি করে। রবিবার রাতে গোয়েন্দা তথ্যর ভিত্তিতে, মৌলভী আকিজসহ ৮-১০ জন আরসা সদস্য ক্যাম্প-৪ এর একটি পরিত্যাক্ত ঘরে গোপন বৈঠক করছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে মৌলভী অলি আকিজসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় একটি বিদেশী পিস্তল, একটি দেশীয় তৈরী এলজি, একটি ওয়ানশুটার গান, ১০ রাউন্ড কার্তুজ, দুকেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ৩টি বাটন মোবাইল ফোন এবং নগদ আড়াইহাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতার মৌলভী অলি আকিজ ২০১৭ সালে সীমান্ত পার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং ক্যাম্প-৫ এ সপরিবারে বসবাস শুরু করে। তিনি আরসার নেতৃত্ব পর্যায়ের একজন সক্রিয় সদস্য এবং ক্যাম্প-৫ এর আরসা হেড জিম্মাদারের দায়িত্বে ছিলেন। নেটওয়ার্ক গ্রুপে কাজ করে বিভিন্ন খবরাখবর আরসা কমান্ডারদের নিকট পৌঁছে দিতো। এভাবে ধীরে ধীরে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে মৌলভী আকিজ রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। তাছাড়া মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে সংঘঠিত চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। এছাড়াও ২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এ সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুত্বর আহত হন। উক্ত হত্যাকান্ডের সাথেও তিনি সরাসরি জড়িত ছিল বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ১৩টি হত্যা, একটি অস্ত্র, দুটি অপহরণ, দুটি এসল্ট, একটি ডাকাতি এবং বিস্ফোরক আইনে একটি মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে সর্বমোট ২১টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতার মাস্টার ফয়সেলও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং ক্যাম্প-২ এ বাস শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ক্যাম্প-৬ এ চলে আসে। তিনি ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ক্যাম্প জিম্মাদার আব্দুল হাকিম, মাস্টার রফিক এবং শামসুর রহমানের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে। তার দূরদর্শী কর্মকান্ডের ফলে সময়ের ব্যবধানে তিনি বাংলাদেশে আরসার লজিষ্টিকস্ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পায়। তার সাথে আরসার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় ওস্তাদ খালিদ ও আরসার লজিষ্টিকস্ শাখার প্রধানের চাহিদানুযায়ী বাংলাদেশ হতে বিভিন্ন লজিষ্টিকস্ সরঞ্জামাদি কাপড়, শীত বস্ত্র, রেইনকোট, বুট, জুতা, মোজা ইত্যাদি লেদা বরইতলী ঘাট ও তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণ করতো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত আরসা সদস্যদের বেতন ও অসুস্থ এবং আঘাতপ্রাপ্ত সদস্যদের চিকিৎসা সহায়তা তার মাধ্যমে প্রদান করা হতো। এছাড়াও তিনি রোহিঙ্গা যুবকদের আরসায় রিক্রুটিং করতো। তার মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০-১১০ জন রোহিঙ্গা যুবক আরসায় যোগদান করেছে বলে জানা যায়।
হাফেজ ফয়জুর রহমান ২০১৪ সালে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে টেকনাফ শাহ-পরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে ভর্তি হয়। ২০১৭ সালে তার পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ক্যাম্প-২০ এ বসবাস শুরু করে। তিনি ২০১৯ সালে আরসায় যোগ দেন এবং কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং ঢাকা হতে আরসার জন্য বিভিন্ন লজিস্টিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা সদস্যদের নিকট প্রেরণ করতো। ইতিমধ্যে আরসার প্রায় ১২০টি ওয়াকিটকি সেট ও বিপুল পরিমাণ লজিস্টিকস্ সামগ্রী এ পর্যন্ত সরবরাহ করেছে। এছাড়াও ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গা যুবকদের আরসায় যোগদানে উৎসাহিত করতো।
মাস্টার সালামও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্প-৮/ই, ব্লক-বি/৪৪ এ বাস শুরু করে। সে ২০২০ সালের মারকাসের কমান্ডার হাফেজ সিরাজের মাধ্যমে আরসায় যোগদেন । আরসায় যোগদানকৃত রিক্রুটদের পার্শ্ববর্তী দেশে প্রশিক্ষণে প্রেরণ, এ সময় তাদের পরিবারকে ৫ হাজার এবং প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে এলে সাড়ে ৩ হাজার টাকা প্রদান করা হতো। যার বিস্তারিত হিসাব রক্ষক ছিলেন গ্রেফতারকৃত মাস্টার সালাম।
গ্রেফতারকৃত জুবায়ের বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার প্রধান কমান্ডার ও ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য শরণার্থী শিবিরে দফায় দফায় সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করতো। আরসায় লজিষ্টিকস সামগ্রী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতেন তিনি। এছাড়াও চাহিদাক্রমে এ সকল সামগ্রী পার্শ্ববর্তী দেশে আরসার নিকট প্রেরণসহ সাধারণ রোহিঙ্গা যুবকদের আরসায় যোগদানে উদ্বুদ্ধ করতো।
আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে অদ্যাবধি ২৩ জন নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে উল্লেখ করনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী।