আন্তর্জাতিক ডেস্ক »
কালো টাকা। টাকা কি কখনও কালো হয়? টাকার অর্থাৎ নোটের নানা রকমের রঙ হতে পারে। তবে এটি সত্যি, পৃথিবীর কোথাও কালো টাকা নেই। কিন্তু কালো টাকার কথা হরহামেশাই শোনা যায়। আর বাজেট এলে খুব বেশি আলোচনা হয় কালো টাকা নিয়ে। কালো টাকা মানে অবৈধভাবে অর্জিত কিংবা অপ্রদর্শিত টাকা।
টাকাকে কালো বলা হয় প্রতীকী অর্থে। আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করা হবে। সুতরাং নানা দিকে কালো টাকা নিয়ে আলোচনা চলছে। তার আগে আমরাও এ বিষয়ে কিছুটা চর্চা করে নিতে পারি।
অবৈধভাবে অর্জিত সব টাকাই কালো টাকা। আবার বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ যেটা কর দেওয়া প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়নি, সেটাও কালো টাকা। কালো টাকার পাহাড় গড়ে তোলে আসলে দুষ্কৃতকারী, কালোবাজারি, কর ফাঁকিবাজ ও আন্ডারগ্রাউন্ডের দুষ্ট লোকজন।
সোনার বাজার, গৃহায়ণশিল্প, টাকার লেনদেনে হুন্ডির আশ্রয় ও করমুক্ত পরিবেশে ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে কালো টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। পৃথিবীর অনেক দেশ ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ হিসেবে পরিচিত।
কালো টাকার লেনদেনের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নানা রকমের চক্র আছে। ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও ঘুষখোর, মানবপাচারকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত। এরা লোভী। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য, সম্পদ ও অর্থ কুক্ষিগত করা। এরা অর্থলোভী এবং ‘কালো টাকার কালো মানুষ’।
আমরা এখন আসতে পারি সাদা টাকার আলোচনায়। সাদা টাকা আসলে কী? বৈধভাবে উপার্জিত এবং কর পরিশোধিত অর্থই সাদা টাকা। অনেক সময় বৈধভাবে উপার্জন করেও আপনি কালো টাকার ফাঁদে পড়ে যেতে পারেন। যদি না সে টাকার কর পরিশোধ না করেন। সুতরাং সম্পদ এবং অর্থের সব তথ্য সরকারি নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে একজন সাদা টাকার মালিক ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারেন।
পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থও কালো টাকা। যেমন, চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। যদি কোনো চিকিৎসক সেই অর্থ আয়কর রিটার্নে না দেখান, তা হলে সেটি কালো টাকায় পরিণত হয়।
বাংলাদেশে কালো টাকার একটি বড় অংশ পাচার করা অর্থ। এছাড়া বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিও কালো টাকা।
রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের জমি সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। ফলে এসব জমি-বিক্রয়ে সরকার বাজারমূল্য অনুযায়ী বা সত্যিকার অর্থে যে দামে ক্রয়-বিক্রয় হয়, সে দাম অনুযায়ী রাজস্ব পায় না। এভাবেই এ প্রক্রিয়াটি প্রতিবছর বিপুল টাকাকে কালো তালিকায় নিয়ে যায়।
কালো টাকা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। কারণ বিপুল অর্থের কর আদায় না হওয়ায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গেও এ অর্থের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এতে বৈধ ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
অনেক বেশি লাভের আশায় লোকজন কালোবাজারের অর্থনীতিতে অংশ নেয়। কিন্তু মোট জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি) ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবের বাইরে থেকে যায় এ অর্থ। এতে জাতীয় সঞ্চয়, ভোগ ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতির অন্য হিসাব-নিকাশগুলোও ভুল পথে পরিচালিত হয়। অর্থনৈতিক হিসাব যথাযথ না হওয়ায় পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণে তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
কালো টাকার লাভ-ক্ষতি
বিভিন্ন অবৈধ উপায় কালো টাকার উৎস হলেও এ অর্থ নিজেই একটি বড় সংকট। কারণ মানুষের হাতে অনেক বেশি কালো টাকা থাকলে তাতে দুর্নীতি বাড়ে। অপরাধ জগতে এসব অর্থ বেশি ব্যবহৃত হয়। কালোবাজার ও অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ঘুষ লেনদেনে অতিরিক্ত মাত্রা পায়। এতে অপরাধীরা আরও মওকা পেয়ে যায়। লাগামহীনভাবে নিজেদের অবৈধ তৎপরতা তারা চালিয়ে যেতে পারে। আবার যারা আইনকানুন মেনে বিনিয়োগ করতে চায়, তারা কালো টাকার সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে নষ্ট হয় অর্থনৈতিক ভারসাম্য।
তবে নিপীড়ক আইন বহাল আছে এমন দেশগুলোতে কালো টাকার সুবিধাও অনেক। যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ বাজার অর্থনীতির লেনদেন নিষিদ্ধ ছিল। এতে নিজেদের ঘাটতি পূরণে ও নিষিদ্ধ পণ্য পেতে লোকজন কালোবাজারের দারস্থ হয়েছিল। অনেক সময় সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য নাগালের বাইরে চলে যায়। অতিরিক্ত ভোক্তা করও মানুষকে বিপদে ফেলে দিতে পারে। আর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে কালো টাকা।
এমনকি পরিকল্পিত বর্ণবাদের প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে এ অবৈধ অর্থ। কোনো কোনো দেশে নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা বর্ণের লোকজনের ভূমির মালিকানা নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। তাদের স্বাভাবিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এতে এসব মানুষ এমন সব জায়গায় চলে যান, যেখানে আইনের কোনো বালাই নেই। সকল চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে তারা সেখানে অবাধে কালো টাকা আয় করে।
কালো টাকা কীভাবে সাদা করা হয়
কালো টাকার মালিকরা তাদের অর্থ বৈধ করারও চেষ্টা করেন। যা ‘সাদাকরণ’ হিসেবেই পরিচিত। যদিও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, নতুন বাজেটে কী হয়, তা জানতে অপেক্ষা করার বিকল্প নেই।
অপ্রদর্শিত অর্থের আয়কর রিটার্ন ঘোষণা দিয়ে তা সাদা করা হয়। এতে তারা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরে আসে। এ কর জিডিপির হার বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের বাজেট ঘাটতি কমাতে সহায়তা করে। অর্থনৈতিক চাপের প্রভাব কাটাতে সরকার এই সুযোগ দেয়।
বাজেটে হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়াও জমি, ভবন, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের ওপর প্রতি বর্গমিটারে নির্দিষ্ট হারে এবং গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় অর্থমন্ত্রীকে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী গোষ্ঠী সরব থাকে সব সময়। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির বিরাট অংকের অর্থ কালো টাকা হিসেবে রয়েছে। এসব অর্থই মূলস্রোতে আনতে মাঝেমাঝেই ‘প্রশ্নহীনভাবে’ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
প্রভাবশালীরা কালো টাকা বিদেশে পাচার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
সমালোচকদের মতে, এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। যেমন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থের মোড়কে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দানের বিষয়ে নতুন করে ঘোষণা না দেয়াকে সতর্ক সাধুবাদ জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটি বলছে, পাশাপাশি সৎ করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক এই সুবিধা যেন অন্য কোনো উপায়ে আয়কর অধ্যাদেশে রাখা না হয় সে বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থে এসব টাকার উৎস জিজ্ঞেস না করার নিয়ম সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে থাকা দরকার। কারণ এমন সুযোগ চলতে থাকলে অর্থের কিংবা সম্পদের উৎস অজ্ঞাত থাকলে দেশে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন বেড়ে যেতে পারে। এতে ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য বাড়বে।
দেশে প্রথম কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। এরপর সতেরো বার সেই সুযোগ পায় অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা।
কালো টাকার আকার
দেশে কালো টাকার পরিমাণ নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকা ছিল মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক সাত ভাগ। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ করে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ ভাগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ ভাগ। আর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ৭ ভাগ।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত— জরিমানা করা হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
টিআইবির এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। ওই গবেষণার সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর থেকে অদৃশ্য অর্থনীতির ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে এগারো দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে প্রধান সুপারিশ ছিল কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। সূত্র : সময় নিউজ













