রবিউল হোসেন রবি »
অনেকেরই গায়ের রং কিছুটা মলিন। তাই ফর্সা হওয়ার জন্যে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ব্যবহার করেন নামী-বেনামী রং ফর্সাকারী ক্রিম। কিন্তু এসব ক্রিম ত্বকের উপকার তো দূর- ক্ষতিই বেশি করে। তবুও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের কসমেটিকস দোকানে সয়লাব এসব ক্ষতিকর ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম। এবার ক্ষতিকর মার্কারি (পারদ) ও হাইড্রোকুইনোন এর উপস্থিতি পাওয়ায় এমনই ১৭টি ব্রান্ডের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পরেও এসব ক্রিম বিক্রি থেমে নেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে।
সোমবার (৪ জুলাই) সংস্থাটির পরিচালক মো. নুরুল আমিন সাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত নিষিদ্ধ ক্রিমগুলো হল- গৌরি কসমেটিকস লিমিটেডের গৌরি, এস এন্ড জে মার্কেটিং কোম্পানির চাঁদনী, কিউ.সি ইন্টারন্যাশনালের নিউ ফেইস, ক্রিয়েটিভ কসমেটিকস (প্রা.) লিমিটেডের ডিউ ক্রিম, নূর গোল্ড কসমেটিকস (প্রা.) লি. এর নূর হারবাল বিউটি ক্রিম, একই প্রতিষ্ঠানের নূর গোল্ড বিউটি ক্রিম, গোল্ডেন পার্লের গোল্ডেন পার্ল ক্রিম, হোয়াইট পার্ল কসমেটিকস ইন্টারন্যাশনালের হোয়াইট পার্ল প্লাস, পুনিয়া ব্রাদার্স (প্রা.) লি. এর ফাইজা, লাওয়া ইন্টারন্যাশনালের প্যাক্স, লাইফ কসমেটিকসের ফ্রেশ অ্যান্ড হোয়াইট, ফেস লিফট কসমেটিকসের ফেইস লিফট, শাহিন কসমেটিকস (প্রা.) লিমিটেডের ফেইস ফ্রেশ, গুয়াজুং টাটা বায়ো টেকনোলজি লি. ডা. রাসেল নাইট ক্রিম, নামবিহীন প্রতিষ্ঠানের ক্রিম ফোরকে প্লাস ও আনিজা কসমেটিকসের আনিজা গোল্ড ক্রিম, গোল্ড কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর গোল্ড।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, বিএসটিআই কর্তৃক খোলাবাজার থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের রং ফর্সাকারী স্কিন ক্রিমের নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআই’র ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মার্কারি (পারদ) ও হাইড্রোকুইনোনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাই এসব পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণ থেকে বিরত ও ক্রয় থেকে সতর্ক থাকার জন্য ভোক্তাদের অনুরোধ করা হয়।
সরেজমিনে নগরীর তামাকুমণ্ডি লেইন রিয়াজউদ্দিন বাজার পাইকারি কসমেটিকসের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, এসব নিষিদ্ধ ক্রিমই যেন পাইকারি ও খুচরা দোকানের মূল আকর্ষণ। ক্রেতারাও প্রতিদিন কিনছেন এসব ক্রিম। ক্রেতাদের বলছেন, এসব ক্রিম ত্বকে মাখলে দ্রুত ফর্সা হওয়া যায়।
কথা হয় তামাকুমণ্ডি লেইনের একাধিক বিক্রেতার সাথে। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা এসব রং ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রি করে আসলেও এখানে কোন অভিযান চালানো হয় না। তাছাড়া কাস্টমারদের পছন্দের শীর্ষে এসব ক্রিম, তাই তারাও বিক্রয় করছেন দেদারসে।
এগুলো তো বিক্রয় নিষিদ্ধ তবুও কিভাবে আনেন— এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম নামে এক কসমেটিক্স ব্যবসায়ী বলেন, ‘পরিচিত ইমপোর্টারদের মাধ্যমে আমরা এসব প্রসাধনী পণ্য গোপনে আনি। প্যাকেটে কয়েক হাজার পিসের মত আনা হয়। আমাদের বিভিন্ন পার্টি আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা এসে দিয়ে যায়। ক্রেতা চাহিদা থাকায় আমরাও বিক্রি করি।’
ডিউ ক্রিম কিনতে আসা রাফা নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি এই ক্রিম ব্যবহার করি আজ ৩ মাস যাবত। আমার খালার কাছ থেকে আমি এই ক্রিমের নাম প্রথম শুনি। তিনিও অনেকদিন যাবত এই ক্রিম ব্যবহার করেন। আমার মুখের রং কিছুটা কালো হওয়াতে তিনিই আমাকে এই ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নিউজে মাঝেমধ্যে দেখি এসব ক্রিম ক্ষতিকর। কিন্তু অনেকেই তো ব্যবহার করে। আর দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমিও ব্যবহার করছি।’
বিএসটিআই’র তথ্যমতে, বিডিএস অনুযায়ী ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম গুলোতে মার্কারির স্ট্যান্ডার্ড মাত্রা ১.০০ পিপিএম এর নিচে থাকার কথা থাকলেও পরীক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী ক্রিম গুলোতে মার্কারির পরিমাণ পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত। গৌরি ক্রিমটিতে মার্কারির মাত্রা ১০২.৯৯ পিপিএম, চাঁদনীতে ২০৯.৯১ পিপিএম, নিউ ফেইসে ২১৬.৬৯ পিপিএম, ডিউ ক্রিমে ১৩৩.৫০ পিপিএম, নূর হারবাল বিউটি ক্রিমে ২২২.২১ পিপিএম, নূর গোল্ড বিউটি ক্রিমে ১৪৩.৬০ পিপিএম, গোল্ডেন পার্ল ক্রিমে ১২৪.২৮ পিপিএম, হোয়াইট পার্ল প্লাস ক্রিমে ২০১.৯৯ পিপিএম, ফাইজা ক্রিমে ১৮৩.৩৯ পিপিএম, প্যাক্স ক্রিমে ২১৯.১৩ পিপিএম, ফ্রেশ অ্যান্ড হোয়াইট ক্রিমে ৬২.৬৮ পিপিএম, ফেইস লিফট ক্রিমে ১৯০.৫০ পিপিএম, ফেইস ফ্রেশ ক্রিমে ২০১.৪০ পিপিএম, ডা. রাসেল নাইট ক্রিমে ৬৫.৪৪ পিপিএম, ৪কে প্লাস ক্রিমে ৪০.৬০ পিপিএম, আনিজা গোল্ড ক্রিমে ১৯২.৩০ পিপিএম, গোল্ড ক্রিমে ৮৮.৭০ পিপিএম।
এদিকে আনিজা গোল্ড এবং গোল্ড ক্রিমে মার্কারির পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে হাইড্রোকুইনোন। বিডিএস অনুযায়ী, যার মাত্র ৫.০০ পিপিএম এর নিচে থাকার কথা থাকলেও ক্রিম দুটোতে হাইড্রোকুইনোন এর পরিমাণ রয়েছে যথাক্রমে ৩০.২৫ পিপিএম এবং ৮.২০ পিপিএম।
ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র এন্টন আলেকজানড্রফের মতে, পুরো ত্বক ফর্সা করার নিরাপদ কোন উপায় নেই। দোকানে যেসব ক্রিম বিক্রি হয় সেগুলো যে আসলেই গায়ের রং ফর্সা করে— এমন প্রমাণ নেই, এর উল্টো ফলও হতে পারে। এই ক্রিম ত্বককে অস্বাভাবিক রকমের সাদা অথবা আরও কালো করে দিতে পারে। এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের স্বাভাবিক গুণাবলিও।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ক্রিমগুলোর রয়েছে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এসব ক্রিম দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ত্বকে চুলকানি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, ফুলে যাওয়া, ফুসকুড়ি পড়তে পারে। এছাড়া এতে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। কিডনির ক্ষতি থেকে শুরু করে হতে পারে কালশিটে দাগ পড়া, ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাওয়া, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, মানসিক অস্থিরতা থেকে বৈকল্য ও স্নায়ু-জনিত সমস্যা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক (সিএম) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘দেশি-বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ১৭টি ব্রান্ডের রং ফর্সাকারী ক্রিমের নমুনা বিএসটিআই’র ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা শেষে ওইসব ক্রিমের নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মার্কারি (পারদ) ও হাইড্রোকুইনোন এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। বর্তমানে এসব ক্ষতিকর মার্কারি ও হাইড্রোকুইনোন যুক্ত রং ফর্সাকারী ক্রিম উৎপাদন, আমদানি, ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিএসটিআই’র মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সকলকে এ ধরনের পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া ভোক্তা সাধারণদের এ ধরনের পণ্য ক্রয় ব্যবহার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি।’













