মাকসুদ আহম্মদ, বিশেষ প্রতিবেদক »
তিন দফায় সময় বাড়ানোর পরও তদন্ত রিপোর্ট জমা দিচ্ছে না ডিভিশনাল ট্রান্সপোটেশন অফিসার (ডিটিও) মোহাম্মদ আনসার আলীর নেতৃত্বে থাকা কমিটি।
গত ২৯ জুলাই (শুক্রবার) রেলপথে ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোর মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সর্বশেষ ৬ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনাস্থল ও হাসপাতালসহ মোট ১৩ জন পর্যটকের প্রাণহানি ঘটেছে। মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলপথে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মাইক্রো জব্দ করে রাখা হয়েছে থানায়।
প্রশ্ন উঠেছে, তদন্ত রিপোর্টের বিলম্বে মর্মান্তিক জীবনহানীর ঘটনার তদন্ত কি নিস্তেজ হয়ে যাবে। কেননা ৩ কর্মদিবসের স্থলে ৬ কর্মদিবস পার হয়েছে। ৭ আগস্ট বিকেল ৫টা পর্যন্ত রিপোর্ট জমা দেয়নি কমিটি। অবাক হওয়ার বিষয়, পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর হোসেনও ঠিক বলতে পারছেন না কখন রিপোর্টটি তার হাতে আসবে।
এদিকে, তদন্ত কমিটির প্রধান ডিটিও আনসার আলীও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন না। ডিটিও’র দফতর সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। তবে বৃহস্পতিবার (৫ আগষ্ট) ওই ট্রেনের লোকোমটিভ মাস্টার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো মাস্টার এবং ঘটনাস্থলের পয়েন্টম্যানসহ বেশ কয়েকজিন ডিটিও’র দফতরে জবানবন্দি দিতে গেছেন বলে ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার দফতর সূত্রে জানা গেছে।

বিভাগীয় প্রকৌশল-১/পূর্ব সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত রিপোর্টে সর্বশেষ কোচিংয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ ১৩ পর্যটকের মৃত্যু নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ এখনও কোন ধরনের দায়ভারের কথা স্বীকার করেনি। সম্পূর্ণ দায় মাইক্রো চালকের ওপর তুলে দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যদের মধ্যে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের আংশিক তৈরি হয়েছে। সম্পূর্ণ রিপোর্ট তৈরি হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
প্রত্যক্ষভাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে বড়তাকিয়া স্টেশনের ৫৪/৬-৭ কিমি. দূরে খৈয়াছড়া রেলগেট তথা দুর্ঘটনাস্থল। ঘটনার দিন স্টেশনের প্রায় ৪০ গজের মধ্যে থাকা পাসিং পয়েন্টস মাইক্রোর চাপে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ঘটনার একদির পর এই পয়েন্টটি ঠিক করা হয়েছে। স্টেশন থেকে হোম সিগন্যাল মাত্র ১০০ গজ দূরে। এই স্টেশন থেকে উর্দ্ধমুখী আউটার সিগন্যাল প্রায় ৪২০ গজ দূরে। নিম্নগামী মহানগর প্রভাতী ও উর্দ্ধগামী মহানগর এক্সপ্রেসের ক্রসিংয়ের জন্য বড়তাকিয়া স্টেশনের উভয়দিকের হোম সিগন্যাল ও আউটার সিগন্যালের গ্রীন বাতি ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে রেলওয়ে কন্ট্রোল বিভাগ।
অভিযোগ উঠেছে, সিগন্যালিং ডিপার্টমেন্ট অন্য একটি গেট থেকে আকবর হোসেন নামের একজন এনে এখানে পয়েন্টস ম্যানের কাজ করানো হচ্ছে।
এদিকে, ঘটনার দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেনারেল ম্যানেজার/পূর্ব, ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার/১ সহ বেশ কয়েক কর্মকর্তা। পয়েন্টস মেরামতের সময় সিগন্যাল ইন্সপেক্টরসহ আরো কয়েকজন গিয়েছিলেন বড়তাকিয়া স্টেশনে। কিন্তু তদন্তের উদ্দেশ্যে মিরসরাই ও বড়তাকিয়া স্টেশনে এখনও কমিটি সদস্যের উপস্থিতি টের পায়নি কোন প্রত্যক্ষদর্শী।
এ বিষয়ে ডিভিশনাল ট্রান্সপোটেশন অফিসার (ডিটিও) মোহাম্মদ আনসার আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তিনি মুঠোফোন রিসিভ না করায় তদন্ত রিপোর্ট প্রদানে কেন সময়ক্ষেপন হচ্ছে তা জানা যাচ্ছে না। ফলে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে সঠিক তদন্ত।
আরও জানা গেছে, ডিটিও রেলভবনে ও ডিআরএম/পূর্ব দফতরসহ মোট দুটি দফতরের দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকেন।
ট্রেন ও ট্র্যাক পরিচালনার সতর্কীকরণে উল্ল্যেখ আছে, রেল লাইনের ১৬ ফুটের মধ্যে কোন প্রাণীর প্রবেশ নিষেধ। রেল ট্র্যাক এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। স্টপেজ না থাকলে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের গতি হবে কমপক্ষে ১৬ কিমি.। স্টপেজ থাকলে ৫কিমি. আগ থেকে ইঞ্জিনের নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই (শুক্রবার) দুপুর দেড়টায় মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া স্টেশনে দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের ক্রসিং ছিল । এসময় অবৈধ ভাবে আউটার সিগন্যাল ও ব্যারিয়ার উপেক্ষার অভিযোগ মাইক্রো চালকের বিরুদ্ধে। যদিও মাইক্রোর চালক মারা গেছে এবং গেটম্যান গ্রেফতার আছে।
জানা গেছে, এ মৃত্যুর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে রেল ট্র্যাক আইন অমান্য করা। গেট কিপার মিরসরাই ও বড়তাকিয়া স্টেশন মাস্টারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যারিয়ার ফেললেও তা মেনে নেয়নি ১৪ তরুণ পর্যটকের দল ভর্তি মাইক্রো চালক। রেলপথের উত্তর দিকের ব্যারিয়ার ফেলা হলেও দক্ষিণ দিকের ব্যারিয়ারটি নামানো হয়নি। জোর করে লাইনে উঠে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে মাইক্রো (চট্টমেট্রো-চ-৫১-২৩৫০) চালকসহ ১৫ পর্যটকের গাড়ি। দুপুর ১টা ৩৫মিনিটের সময় এ ঘটনায় চট্টগ্রামমূখী ডাউন লাইনের পয়েন্টস মেশিনটিও নষ্ট হয়ে গেছে। প্রকৌশল বিভাগের এনালগ এই গেটটিতে দুটি ম্যানুয়েল ব্যারিয়ার রয়েছে। ফলে দুটি ব্যারিয়ার একসঙ্গে ফেলা যায় না।
আরও জানা গেছে, ভোর সকালেই ৩ শিক্ষকসহ ১৪ জন ঘর থেকে বেরিয়ে যুগিরহাটসস্থ কোচিং সেন্টারের সামনে যায়। হাটহাজারীর যুগিরহাটস্থ শেখ মার্কেটের নীচতলায় থাকা কোচিং সেন্টারের ৩শিক্ষকসহ ১৪ ছাত্রের আনন্দ ভ্রমণ মাটি হয়ে গেল মাত্র ৫মিনিটেই মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া স্টেশনের অনতিদূরে। দুপুর দেড়টার দিকে খৈয়াছড়া পাহাড়ি ঝরণা দেখে ফেসবুকে ছবি আপলোড করেই বড়তাকিয়াস্থ রেল গেট অতিক্রম করছিল অতি পরিচিত মাইক্রো ড্রাইভারসহ উচ্চস্বরে গান গেয়ে গেয়ে। চোখের পলকে মাইক্রোটি ট্রেন ইঞ্জিনের (৩০২৩ সিরিয়ালের) বাফার ও এবিসি কাপলারের সঙ্গে আটকে যায়। চালক ইঞ্জিনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে করতে চলে যায় প্রায় ৫০০ মিটার তথা বড়তাকিয়া স্টেশনের প্রায় ৪০ গজের মধ্যে। ঘটনাস্থলে চালক সজোরে ব্রেক কষলে ট্রেনের প্রায় ৮০০-৯০০ যাত্রীও মৃত্যু পথযাত্রী হতো। কমপক্ষে ৫ কি.মি. আগ থেকে ট্রেন ইঞ্জিন থামানোর প্রস্ততি নিতে হয় লোকোমাস্টার বা চালককে।
এ ব্যাপারে রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলাধারাকে বলেন, এখনও তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি কমিটি। তদন্ত শেষ হয়নি। কমিটি দু’দফায় সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই রিপোর্ট হয়ত জমা দেবে।













