রবিউল হোসেন রবি»
গৃহবধূ আইনুর নাহার সিমা (৩৭) দীর্ঘদিন যাবত গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। কয়েক দফা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েও রোগের সমাধান না হওয়ায় এপিক হেলথ কেয়ার এবং শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করান তিনি। সেখান থেকে আসা রিপোর্টে ধরা পড়ে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের মালিকানাধীন হাসপাতালে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারের অপারেশনের ৯ দিন পর মৃত্যু হয় ওই রোগীর।
এদিকে অপারেশনের পর ওই টিস্যু নিয়ে অপর একটি ল্যাবরেটরিতে একাধিকবার টেস্ট করার পর রিপোর্টে অপসারণকৃত ওই টিস্যুতে পাওয়া যায়নি ক্যান্সারের অস্তিত্ব। ডাক্তারের ‘ভুল চিকিৎসা’ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্টের ফলেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। তবে অপারেশন করা ওই ডাক্তারের দাবি— রোগীর মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক এরেস্টের (হৃৎকম্পন পুরোপুরি বন্ধ) ফলে।
নিহত গৃহবধূ আইনুর নাহার সিমা হালিশহর থানার ঈদগাঁ বউবাজার এলাকার বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া। তার একটি পুত্র এবং কন্যা সন্তান রয়েছে।
অভিযুক্ত ডাক্তারের নাম মো. সাইফুল হক। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। এছাড়া পাঁচলাইশের মির্জারপুল সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় ‘একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি হাসপাতাল রয়েছে তার।
নিহতের ভাসুর মো. শফিক বাংলাধারাকে বলেন, ‘ডাক্তারের অবহেলা এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্টের কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। রোগীর সমস্যা নির্ণয়ের জন্যে আমরা শেভরন এবং এপিকে টেস্ট করাই। সেখানের রিপোর্টে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তার ভিত্তিতে আমরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. আজগরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি আবার রেফার করেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল হকের কাছে। তিনি ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অপারেশন করার কথা জানান।’
তিনি বলেন, ‘এরপর পাঁচলাইশে ওনার মালিকানাধীন একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ৮ আগস্ট অপারেশন করানো হয়। অপারেশনটা আসলে উনি আসলে মনোযোগ দিয়ে করেননি। আমাদের বলা হয়েছে এটি পাঁচ ঘন্টার অপারেশন। সেটি উনি সোয়া দুই ঘন্টার মধ্যেই করে ফেললেন। অপারেশন করার সময় ছিদ্র করে ফেলছে। ৯ দিন ভর্তি রাখার কথা বলা হলেও ৬ দিনের মাথায় উনি রিলিজ করে দেন। বাসায় আসার পর অপারেশনের জায়গা দিয়ে রক্ত ও পুঁজ বের হয়।’
‘ডাক্তারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে আবার সেই একুশে হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং তিনি ড্রেসিং করে দেওয়ার পরেও কোন উন্নতি হয়নি। এরপর ফোন দিলে তিনি আবারও একুশে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। এরপর ওটিতে নিয়ে চেক করে নিজেই স্বীকার করেন এখানে একটি ফুটো হয়ে গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিব।’
‘আজ সকাল ১০ টায় ডা. সাইফুলের পরামর্শে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করাই। এরপর আজ সকালে রোগীর পালস ছিলনা। পালস না থাকা অবস্থাতেই দুটি ইনজেকশন দিছে। সন্ধ্যায় বুঝতে পারি যে সে দুনিয়াতে আর নেই।’—যোগ করেন শফিক।
একই টেস্টের দুই রকম রিপোর্ট ভিন্ন ল্যাবরেটরিতে
একই টেস্ট দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিন্ন রিপোর্ট দিয়েছে অভিযোগ করে শফিক বলেন, ‘অপারেশন করার পরে ক্যান্সার আক্রান্ত যে টিস্যুর কথা বলা হয়েছে সেটি চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ল্যাবরেটরি সাইটো-সাইটে পাঠাই। ওখানের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ডাক্তার সাহাবুদ্দিন সাহেব ৪-৫ বার এটা পরীক্ষা করে বললেন এখানে আমি ক্যান্সারের কোন টিস্যু এখানে পাইনি। ক্যান্সারের টিস্যু এটা অসম্ভব।’
‘তাহলে আমাদের প্রশ্ন হল শেভরন যে এন্ডোসকপি করল, এপিক যে টেস্ট গুলো করে ক্যান্সারের রিপোর্ট দিল সেগুলো আসলে কি ছিল?’— বলেন তিনি।
এপিক হেলথকেয়ার থেকে করা পেটের আল্ট্রাসনোগ্রামে পোস্ট-গ্রাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট অধ্যাপক ডা. মো. দিদারুল আলমের সাক্ষরিত ওই রিপোর্টে ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে অপারেশন করে অপসারণকৃত টিস্যুটি সাইটো-সাইট ল্যাবে নিয়ে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করান রোগীর স্বজনরা। সেই রিপোর্টে নিয়ে যাওয়া অংশে কোন ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

ডাক্তারের দাবি রোগীর মৃত্যু ‘কার্ডিয়াক এরেস্টে’
এদিকে অভিযুক্ত ডাক্তার সাইফুল হক নিজেকে সার্জারির বিষয়ে অভিজ্ঞ উল্লেখ করে দাবি করেন—তার অবহেলায় বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়নি। রোগীর মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক এরেস্টের ফলে।
ডা. সাইফুল হক বাংলাধারাকে বলেন, ‘আমি সিমা নামে ওই রোগীর অপারেশন করেছি। রোগী ভালও হয়ে গেছে। আমি ৬ দিনের দিন রোগীকে ছেড়ে দিয়েছি বাসায় যাওয়ার জন্য। এটি তো ক্যান্সারের বড় অপারেশন। এন্ডোসকপি করে ডায়াগনোস করা যে ক্যান্সার। তো ছেড়ে দেয়ার পরে ৭ম দিন অপারেশনের জায়গায় একটু লিকেজ ছিল। যার ফলে আবার ভর্তি করে আবার রেখে দিলাম। এরপর বললাম দেখেন এটা তো লিকেজ। কয়েকদিন থাকা লাগতে পারে। আপনারা যদি মনে করেন ক্রাইসিস আছে তাহলে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলে আসেন।’
‘তারা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানে কেবিন ব্যবস্থা করে দিলাম। রোগী খাওয়া দাওয়া করেছে। সকালে প্রসাব-পায়খানা সবই হইছে। সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করে তার কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। তখন আমার ৩ জন ডাক্তার সশরীরে উপস্থিত ছিল পাশে। এখন কার্ডিয়াক এরেস্টে তো কারও হাত নেই, তাইনা?’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব অপারেশনের জটিলতার কারণে রোগীর যদি কিছু হয় সেক্ষেত্রে রোগীর পেট ফুলে যাবে, বমি হবে, জ্বর হবে। কিন্তু রোগীর এসব কোন উপসর্গ ছিল না। রোগীকে চমেকে তো আমি নিজেই তো ভর্তি করলাম। আমি দুপুর আড়াইটার দিকেও খবর নিলাম, নার্স বলল স্যার খাওয়া-দাওয়া সব খাইছে। সম্ভবত, আছরের দিকেও খাইছে।
তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে আমার দুইজন ডাক্তার ফলোআপ দিতে গিয়ে দেখল হঠাৎ করে রোগীর শ্বাস কষ্ট, বুকে ব্যাথা—এসব লক্ষণ। এরপর ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে রোগী মারা গেছে। এটি কার্ডিয়াক এরেস্ট। পেটের অপারেশনজনিত সমস্যা হলে রোগীকে কেউ খাবার দেয় বা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়?’
অপারেশনে অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অপারেশনটা ৫ ঘন্টা সময় নিয়ে করেছি। আমি হলাম এই মুহুর্তে চট্টগ্রামের সিনিয়র মোস্ট মানুষ। আমার ওপরে একজন হেড আছে। ৫ ঘন্টা ধরে অপারেশন করেছি। করার পর রোগী ভাল। ৪৮ ঘন্টা পরে খাবার দিয়েছি। এরপর রোগী আরও ৪ দিন ছিল। ভাত, মাছ, মাংস সব খেয়েছে রোগী। এরপর আমরা নলটা খুলে দিলাম। এর দুইদিন পরে দেখা গেল সেখান থেকে ডিসচার্জ হচ্ছে। এরপর আবার তাদেরকে এনে নলটা পুনরায় স্থাপন করলাম। এরপর তারা বাড়ি চলে গেল।’
ডা. সাইফুল হক বলেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আমরা রোগীকে আইসিউতে নিয়ে যেতাম। স্বাভাবিকভাবে যার কেউ মারা যায় তারা একটু সেন্টিমেন্টাল থাকে। কিন্তু ১০ হাজার কেইস অপারেশন করলে একটা দুইটা কার্ডিয়াক এরেস্ট হইলে তো কিছুই করার নেই।’
এদিকে ডা. সাইফুল হকের দাবি অস্বীকার করে রোগীর স্বজনরা জানান, আমাদের রোগী অপারেশনের পর সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন না। মৃত্যুর আগেও তিনি রক্ত বমি করেছেন। উনি নিজের দোষ আড়াল করতেই এসব কথা বলছেন।’
এ বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হবেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে নিহতের ভাসুর শফিকুল বলেন, ‘গতকাল রাতে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর জানাজা সম্পন্ন হয়েছে এবং দাফনও করা হয়। আমরা পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিব মামলা করব কি-না।’













