সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
২০১৮ সালের সম্মেলনের পর দু’জনের কমিটিতে সাড়ে চার বছর পার করে দিয়েছে কক্সবাজার জেলা যুবলীগ। অপেশাদারি মনোভাবের কারণে দীর্ঘ এ সময়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন সভাপতি-সম্পাদক— এমন অভিযোগ তৃণমূলের। ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ‘মাই ম্যান’ ও সুবিধাভোগীদের দলীয় পদবি দিতে স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের কারণে দু’জনের কমিটি দলীয় গঠণতান্ত্রিক নিয়মে পূর্ণ মেয়াদেরও বাড়তি আরো এক বছর অতিক্রম করেও পূর্ণ কমিটি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হন তারা। দুই সোহেল দায়িত্ব পেয়ে এক হাজার ৫১০দিন (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) পেছনে ফেলে এলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় অস্থিত্ব সংকটে রয়েছে যুবলীগের নেতৃত্ব। নিকট অতীতে সাংগঠনিক কোন প্রোগ্রাম নিয়ে যুবলীগের প্রাণচঞ্চলতা জানান দেয়া কিংবা সাজাতে ব্যর্থ হয়েছেন তৃণমূল যুবলীগও। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে আছে প্রায় সব উপজেলা-পৌর কমিটিও। এতে হতাশা সর্বত্র।
তবে, গত ২৮, ২৯ ও ৩০ মে চট্টগ্রাম উত্তর-দক্ষিণ ও মহানগর যুবলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে ঝিমিয়ে পড়া যুবলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে উচ্ছাস দেখা দেয়। প্রত্যাশা জাগে, দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছর পর দুজনের ব্যর্থ কমিটি অচিরেই ভেঙে সম্মেলন হবে। নেতৃত্ব প্রত্যাশিরা কেন্দ্রে যোগাযোগের পর নেতৃবৃন্দের কাছে সম্মেলনের আশ্বাস পেলে শুরু হয় প্রাণচাঞ্চল্য। গত ৪ জুন দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল-প্রতিবাদ সমাবেশ করে যুবলীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা। কক্সবাজার শহর যুবলীগের আহবায়ক শোয়েব ও জেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ ইফতেখারের নেতৃত্বে যুবলীগের বিপুল সংখ্যক তৃণমূলকর্মী বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেন। সংগঠনকে গতিশীল ও সুসংগঠিত করতে দুইজনের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন জেলা কমিটির সম্মেলন কিংবা আহবায়ক কমিটি ঘোষণার দাবি তৃণমূলের।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ জেলায় সর্বশেষ কাউন্সিলে যুবলীগের সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুর ও সাধারণ সম্পাদক হন শহীদুল হক সোহেল। সম্মেলনে তৎকালীন চেয়াম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত দেন, জেলার বিদায়ী সভাপতি খোরশেদ আলম ও সাধারণ সম্পাদক মাবুর পরামর্শক্রমে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে কেন্দ্রে জমা দিবেন নব নির্বাচিত সভাপতি-সম্পাদক। কিন্তু বিদায়ী সভাপতি-সম্পাদককে পাশ কাটিয়ে সবার অগোচরে সভাপতি-সম্পাদক বাটোয়ারায় নিজেদের অনুগত ৫০ ও ৫১ জন মিলিয়ে ১০১ সদস্যের একটি তালিকা কেন্দ্রে জমা দেন। ২০১৯ সালে জমা দেয়া তালিকায় জামাত শিবিরের কর্মী, চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী, একাধিক মামলার আসামীসহ একেবারে অপরিচিত ও নতুন ব্যক্তিদের সনাক্ত করেন ত্যাগীরা। তালিকায় বাদ পড়েন ত্যাগীরাসহ বর্তমান সভাপতি-সম্পাদকের সাথে কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্ধিতাকারিরাও। এসব বিষয় লিখিতভাবে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগীয় দায়িত্ব প্রাপ্ত) শেখ ফজলে নাঈমকে জানানোর পর আলোর মুখ দেখেনি জেলা যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
গত সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ও পৌর যুবলীগ আহবায়ক শোয়েব ইফতেখার বলেন, দুই সোহেল সভাপতি-সম্পাদক হয়ে গত সাড়ে চার বছরে পৌরসভা ও উপজেলা কমিটিগুলোও গোছাতে ব্যর্থ হন, ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ দিয়েই চলছে সব পৌর ও উপজেলা কমিটি। সভাপতির একক আধিপত্য, দাম্ভিকতা ও সিনিয়রদের সাথে অশালীন আচরণে দুঃসময়ে মাঠে থাকা অনেকে রাজনীতি ছেড়েছেন। নিজেও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে যুবলীগে আসায় ছাত্র ইউনিয়নকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেককে যুবলীগ বানানোর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে সভাপতির বিরুদ্ধে। তাদের কারণে নেতৃত্বের বিকাশ এবং সংগঠনে গতিশীলতা আসেনি।
জেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ ইফতেখার জিসান বলেন, চলমান সভাপতি-সম্পাদকের প্রস্তাবিত কমিটিতে ত্যাগী, পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ আদর্শবাদী নেতাকর্মী বাদ পড়েন। নিজেদের আজ্ঞাবহ চাটুকার লেভেলের কিছু ব্যক্তি ছাড়া সংগঠনের প্রকৃত নেতা-কর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই বললে চলে। গত সাড়ে ৪ বছরে সভাপতি-সম্পাদক উল্লেখ্যযোগ্য কোন সাংগঠনিক কর্মকান্ড দেখাতে ব্যর্থ। জেলা আওয়ামী লীগের দিবস ভিত্তিক কর্মসূচিতে ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেয়া ছাড়া একটি বড় মিছিল পর্যন্ত করতে পারেননি তারা। গঠনতন্ত্র মতে কমিটির তিন বছর মেয়াদের বেশি সময়েও পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় নেতৃত্বের বিকাশহীনতায় হতাশ নবীনরা। অথচ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুবলীগের ত্যাগী অগণিত নেতাকর্মী থাকলেও সংগঠন আজ অস্থিত্ব সংকটে।
জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শহিদুল্লাহ জানান, দায়িত্বপাবার পর থেকে সংগঠন সুসংগঠিত না করলেও সভাপতি-সম্পাদক নিজেদের আখের গুছিয়েছেন ভালোই। দুজনের ব্যর্থ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী কর্মীদের হাতে নতুন নেতৃত্ব তুলে দেয়া হউক।
জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মাবু বলেন, অতীত সময়ে যুবলীগকর্মীদের সরব উপস্থিতিতেই মূল দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে বাহাদুর-সোহেল দায়িত্ব পাবার পর সংগঠনটি ‘সভাপতি-সম্পাদক লীগে’ পরিণত হয়েছে। যারা যুবলীগের রাজনীতি করেছেন এবং করতে আগ্রহী তারা সভাপতি-সম্পাদকের কার্যক্রমে খুবই হতাশ। বিরোধী দলের অঙ্গসংগঠনের মতো ঝিমিয়ে রয়েছে কক্সবাজার যুবলীগ। কেন্দ্রের উচিত তাদের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন নেতৃত্ব খোঁজা।
এসব বিষয়ে কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক সোহেল বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্য ২০১৯ সালে কেন্দ্রে ১০১ জনের তালিকা পাঠিয়েছি-কেন্দ্র অনুমোদন না দিলে আমরা কী করতে পারি? মাদক ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও দখলবাজদের নয়, আমরা যাচাই-বাছাই করে গঠনতন্ত্র মেনে সক্রিয়দের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেলে সব উপজেলায় কমিটি গুছিয়ে জেলায় সম্মেলনের উদ্যোগ নেব।
জেলা যুবলীগ সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুর বলেন, কেন্দ্রে পাঠানো তালিকায় নাম থাকা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাদের বাদ দিয়ে কমিটি অনুমোদন দিলেও কোন সমস্যা নেই। আর যেহেতু আমাদের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ-সেক্ষেত্রে প্রশ্ন এড়াতে, কেন্দ্র আমাদের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি দিলেও মেনে নেবো। তবে, স্বেচ্ছাচারিতা ও পদ বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগীয় দায়িত্ব প্রাপ্ত) শেখ ফজলে নাঈম বলেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠন শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে সব জেলা কমিটি সম্পন্ন করব। কক্সবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। পর্যটনসহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ নানা বিষয় মিলিয়ে এখানে স্মার্ট ও ডায়নামিক নেতৃত্ব দরকার। চলমান কমিটির ব্যর্থতার অভিযোগগুলোসহ সবকিছু মাথায় রেখেই আমরা এগুচ্ছি।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, কক্সবাজার থেকে ১০১ জনের একটি তালিকা আমরা পেয়েছি। তালিকায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে দপ্তরে অভিযোগও এসেছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। যাচাই-বাছাই করে গঠনতন্ত্র মেনে কমিটি দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার সদর উপজেলা যুবলীগ ও পৌর কমিটি গঠিত হয় ২০১৭ সালে। টেকনাফ উপজেলা কমিটিও হয় একই বছর এবং টেকনাফ পৌর কমিটি হয়েছে ২০১৮ সালে। উখিয়া উপজেলা ও পেকুয়া উপজেলা কমিটি গঠন হয়েছিল ২০১৫ সালে। রামু ও মহেশখালী উপজেলা এবং পৌর কমিটি গঠন হয় ২০১৬ সালে। কুতুবদিয়া উপজেলা কমিটি হয় ২০১৭ সালে। চকরিয়া উপজেলা কমিটি হয় ২০১৬ সালে এবং পৌর কমিটি হয়েছিল এরও এক বছর আগে ২০১৫ সালে।












