সুমন বৈদ্য »
‘শাহরুখ খান’, যার নামের সাথে মিশে রয়েছে আরও অসংখ্য নাম। রোমান্স যাদুকর, বাদশাহ, ডন কিংবা কিং খান নামে যিনি আমাদের মাঝে পরিচিত। তিনি পর্দায় আসা মানেই যেন বাড়তি উন্মাদনা। তাকে নিয়েই দর্শকমনে কৌতুহল। ক্যারিয়ারের অনেক চড়াই উতরাই পার করে তিনি আজ সবার শীর্ষে। নব্বই দশক থেকে শুরু করে বর্তমান, শাহরুখের অভিনয়ের ক্যারিশ্মার জন্য আজও মুগ্ধ দর্শকমহল। বক্স অফিসে রয়েছে তার একাধিক সুপারহিট সিনেমা। তারই ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমাগুলো নিয়ে থাকছে ‘দেবদাস থেকে কিং খান’ সিরিজের প্রথম পর্ব।
জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস দেবদাস। ২০০২ সালে সঞ্জয় লীলা বানশালী পরিচালিত ‘দেবদাস’ সিনেমাটি ছিল শাহরুখের জন্য ক্যারিয়ার বদলে যাওয়া মতো সিনেমা। এখানে শাহরুখ খান দেবদাস চরিত্রকে এমনভাবে নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন যে ইতিহাসে দেবদাসকে করে দিয়েছেন এক কালজয়ী চরিত্রে। শাহরুখের অভিনয় ছিল এখানে দুর্দান্ত।
গল্পে দেখা যায়, ছোট বেলা থেকে দেবদাসকে ভালোবেসে আসা পার্বতী শেষ পর্যন্ত দেবদাসকে পায় না। অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে দেবদাস নিজেকে ভালো রাখার জন্য মদ্যপান শুরু করে। এরই মাঝে তার জীবনে আসে আরেক বীরাঙ্গনা চন্দ্রমুখী, যে কিনা দেবদাসের প্রেমে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ইতিহাসের এই কালজয়ী চরিত্র।
ছবিটি কিন্তু মোটেই শাহরুখের জন্য সহজ ছিল না, নিজেকে একজন ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবে আর দুঃখে মদ্যপানের অভিনয় ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। তিনি তার সূক্ষ্ম অভিনয় দিয়ে প্রমাণ করলেন— কেনো তিনি বলিউডের বাদশাহ! এ ছাড়াও ছবিটিতে শাহরুখ-ঐশ্বরিয়ার ক্রেমিস্ট্রি ছিল দুর্দান্ত, যা বলা যায় সঞ্জয় লীলা বানশালীর সিনেমায় যুগান্তকারী সৃষ্টি। যা এখনকার সিনেমায় নেই বললেই চলে। একের পর এক সিনেমা টেক্কা দিতে হাজির হলেও, আজও জৌলুস হারায়নি দেবদাস।
এই সিনেমাটিকে তখনকার সময়ে বলিউডের সবচেয়ে এক্সপেনসিভ সিনেমা বলা হয়। কারণ ‘দেবদাস’ ছবির বাজেট ছিল ৫০ কোটি রুপি, যা এখনকার ৫০০ কোটি বাজেটের সমতুল্য বলা চলে। যার মধ্যে ২০ কোটি রুপিই খরচ হয়েছিল শুধু সেট তৈরিতে। ছয়টি বড় সেটে নির্মিত হয় ‘দেবদাস’। ছবিতে ঐশ্বরিয়ার কক্ষটি ছিল কাচ দিয়ে তৈরি। এটা নির্মাণ করতে তখন খরচ হয়েছিল ১ কোটি ২২ লাখ রুপি। যা কিনা পরে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় সাত মাস পর্যন্ত। তাছাড়া ২০০২ সাল পর্যন্ত এত টাকার বাজেটের ছবি এর আগে কেউ করেনি ।
এই ছবির সেট সুন্দর করে সাজানোর জন্য প্রয়োজন হয়েছিল প্রচুর আলোর। প্রতিদিন কাজ করতেন ৭০০ লাইট ম্যান। ছিল ৪০টি এর বেশি জেনারেটর। তাছাড়া এই ছবির জন্যে শাহরুখ করতে হয়েছিল নিজের সাথে চ্যালেঞ্জ। তিনি মদ্যপান করতেন না। কিন্তু নিজের অভিনয় ফুটিয়ে তোলার জন্য এই সিনেমা করার সময় শাহরুখ খান মদ পান করেছিলেন। অভিনয়ের জন্যে এমন নিবেদন সচরাচর তখন দেখা যেত না।
এই ছবির আরেকটা অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে গান, যা এখনো দর্শকমহলে অনেক জনপ্রিয়। ইসমাইল দরবার আর বিরজু মহারাজের পরিচালনায় গানগুলো এখন ও সবার হৃদয়ে গেঁথে আছে। যার মধ্যে ‘দোলা রে’ গানটি বেশ জনপ্রিয়। প্রয়াত সরোজ খানের অসাধারণ কোরিওগ্রাফিতে নাচটিতে অভিনয় করেছিলেন মাধুরী দীক্ষিত আর ঐশ্বরিয়া, যা তাদের ক্যারিয়ারে একটা অনন্য মাত্রা এনে দেয়।
ছবিটিতে দুটি অবাক করা বিষয় হলো ‘পারু’ চরিত্র আর ‘চুন্নিলাল’ চরিত্র। ‘পারু’ চরিত্রে এই ছবির পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন কারিনা কাপুর। কিন্তু প্রস্তাব দেয়ার পর ফিরিয়ে দেন কারিনা। কারিনা কাপুরের বয়স তখন কম থাকায় তার মা এই কাজটি করতে দেননি। এত কম বয়সে এমন কঠিন চরিত্র করতে ঘোর আপত্তি জানান কারিনার মা ববিতা। যার ফলে সিনেমার পর্দায় আর ‘পারু’ হয়ে উঠতে পারেননি কারিনা।
এরপর ‘পারু’ চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই। যা কিনা এখনো বলিউডের একটি ইতিহাস হয়ে আছে। অন্যদিকে শাহরুখ তথা দেবদাসের বন্ধু চুনিলালের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয় সাইফ আলী খান ও গোবিন্দকে। তারা কেউ রাজি হননি। পরে জ্যাকি শ্রফ চরিত্রটি করেন এবং দারুণ প্রশংসিত হন। আর সিনেমায় চন্দ্রমুখীর চরিত্রে নিজেকে পুরোপুরি মিশিয়ে দিয়েছেন মাধুরি দীক্ষিত। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন স্মিতা জ্যাকার, মনোজ যোশী, অনন্যা খের, মিলিন্দ গুণাজি, দীনা পাটক, বিজেয়েন্দ্র ঘাতজ, কিরণ খের, তিকু তালসানিয়া, আভা মুখার্জী, জয়া ভট্টাচার্য, সুনীল রেজ, বিজয় কৃষ্ণ, অমরদীপ ঝা, অপরা মেহতা, মুনি ঝা ও রাধিকা সিং।
ছবিটি ওই বছর কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল এবং ওই বছর ছবিটি ৪৮তম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করে। শাহরুখের জীবনে সেরা অভিনীত সিনেমার তালিকায় এই দেবদাস সিনেমা ছিল অন্যতম।
এই ছবিটির সবচেয়ে অন্যতম মুহূর্তের একটি হল শেষ দৃশ্য। সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, দেবদাস মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে পারুকে একটুখানি দেখার আকুলতা আর পারুর তার প্রিয় দেববাবুকে শেষবারের মতো দেখতে না পারার আক্ষেপ। তা এখনও সবার মনে আবেগের জায়গা ধরে রেখেছে। যা এখনকার ইয়াং জেনারেশনের কাছেও বেশ আবেগঘন জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আর এই সিনেমার ডাইলগগুলো ছিলো হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। যা দেবদাস চরিত্রটিকে আরো বেশি রঙিন হতে সাহায্য করেছে। এখনও অনেকে নস্টালজিক হতে চাইলে এই সিনেমাটি দেখে। যারা এখনো দেখেননি, দেখে নিতে পারেন এই অসাধারণ সৃষ্টি।
লেখক : শিক্ষার্থী এবং ফিল্ম এনালিস্ট