৭ নভেম্বর ২০২৫

বঙ্গোপসাগরের বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলে বাপ-বেটার রাজত্ব, আতঙ্কে জেলেরা

রিয়াদুল ইসলাম, বাঁশখালী »

ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুমে বঙ্গোপসাগর বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাপ-বেটার জলদস্যু গ্রুপ আনছার বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানের শিথিলতার সুযোগে সাগরের বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলে জলদস্যু গ্রুপটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, রূপ নিয়েছে অতি ভয়ঙ্করে। এতে চরম আতঙ্কে রয়েছে জীবিকার তাগিদে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া শত শত জেলে। বর্তমানে বাহিনীটির হাতে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতি, হত্যা, নির্যাতন ও চাঁদাবাজি যেন ডাল ভাতের ন্যায়। হোক ভরা মৌসুম বা অন্য যেকোনো সময়, কিন্তু তাদের এ তাণ্ডবের যেন শেষ নেই।

সম্প্রতি সাগরে সরাসরি ডাকাতিকালে র‍্যাবের অভিযানে আনছার বাহিনীর সেকেন্ড ইন্ড কমান্ড আনোয়ারসহ ১২ সদস্য বিপুল পরিমাণ আয়েগ্নাস্ত্র, দেশীয় অস্ত্র, ডাকাতিকৃত ট্রলার, সরঞ্জাম, শতাধিক মোবাইলসহ আটক করা হয়। কিন্তু গভীর সমুদ্রে বিন্দুমাত্র চেড় পরেনি তাদের রাজত্বে। র‍্যাবের অভিযানে ছেলে আটক হলেও সাগর ও উপকূলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আনছার বাহিনীর প্রধান জলদস্যু সম্রাট আনছার ও তার ছোট ভাই আমিন। তাদের ভয়ে আতঙ্কে ও অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপকূলের হাজারো জেলে এবং মৎস্য ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ভরা মৌসুমেও সাগরে ইলিশ ধরতে যেতে আতঙ্কে আছেন জেলেরা। জেলেদের মুখে জম ভয়ের একটি নাম আনছার বাহিনী।

আনছার বাহিনীর প্রধান ডাকাত আনছার ওরফে আনছার মেম্বার (ইউপি সদস্য)। জনপ্রতিনিধির আড়ালে স্থানীয় এ প্রভাবশালীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বিশাল জলদস্যু বাহিনী। আর এ বাহিনীর নেতৃত্বে তিনি ছাড়াও রয়েছেন তারই আপন ছোট ভাই আমিন ও বড় ছেলে আনোয়ার।

সম্প্রতি ডাকাতিকালে র‌্যাবের অভিযানে আনোয়ারসহ ১২ জলদস্যু আটক হয়েছে

গণ্ডামারা ইউপি চেয়ারম্যান বদিউল আলম প্রকাশ বদু চেয়ারম্যান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এবং ২০১১ সালে এফ’ভি আল্লাহ মালিক ট্রলারসহ ১২ জন জেলে হত্যা ও লাশ ঘুম, ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলের জাহাজখাডি নামক এলাকায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি করে ট্রলারের মাঝিমাল্লাসহ ৩১ জেলেকে হত্যা করে ইট বেঁধে পানিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এদিকে জলদস্যু সম্রাট আনছার গণ্ডামারার ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হলে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর মদদে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেও জানায় জেলেরা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলে জানান, আনছার মেম্বার দীর্ঘদিন ধরে সাগরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তার ভয়ে অনেক জেলে কাপড় চোপড় ভিজিয়ে ফেলে। তার নাম শুনলেই আমাদের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। সে মেম্বার (ইউপি সদস্য) হওয়ার পর এ বাহিনীর নেতৃত্বে দিচ্ছেন তার ছেলে আনোয়ার ও ছোট ভাই আমিন। ডাকাতিকালে র‍্যাবের অভিযানে তার ছেলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ আটক হওয়াতে আমরা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি।

ডাকাতিকালে ব্যবহৃত ট্রলার

এ বিষয়ে আল্লাহ মালিক ফিশিং বোটের মালিক আবুল হোছাইন বলেন, এসব জলদস্যু বাহিনীর জন্য আমরা সাগরে নামতে পারি না। এরা আমার বুকের ধন (ছেলে) আব্বাসসহ ১২ জন জেলেকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমি আমার ছেলের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জলদস্যু মুক্ত হলেও আমাদের সাগরে জলদস্যু মুক্ত হয়নি। অন্যদিকে এসব জলদস্যুর পিছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালী সিন্ডিকেট থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, আমি আমার ছেলেসহ ১২ জেলে হত্যা নিয়ে মংলা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, পতেঙ্গা থানা, কোতোয়ালী থানা, আনোয়ারা ও বাঁশখালী থানাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি তারপরও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেইনি। আমরা জেলেদের একমাত্র সম্বল সাগর। কিন্তু এ সাগর আনছার বাহিনীর মত অসংখ্য জলদস্যু বাহিনীর হাতে বন্দি। আমরা জলদস্যু মুক্ত সাগর চাই। আমি আর সাগরে কোন সন্তানকে হারাতে চাই না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির এক নেতা জানান, আমাদের প্রতি মাসে তাদেরকে টাকা দিতে হয়। টাকা দিতে দেরি হলে তারা জেলেদের হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। তারা বিভিন্ন ট্রলার মালিকদের কাছে টাকার জন্য চিঠি পাঠায়। তাদের প্রাপ্য চাঁদা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর সাগরে ট্রলার নামাতে পারি। তারা এখন আগের চেয়ে প্রভাবশালী তাই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে জীবনটা হারাতে চাই না।

এ বিষয়ে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. কামাল উদ্দীন বলেন, আমি এ থানায় যোগদান করার পর বেশ কয়েকজন জলদস্যুকে আটক করেছি। কিন্তু তারা বেশির ভাগ সময় সাগরে থাকে তাই আমরা কোন একশ্যান নিতে পারি না। সাগর নৌ পুলিশের অধীনে। তারপরও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে সব সময় তৎপর রয়েছি।

র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র

আনছার বাহিনীর সেকেন্ড ইন্ড কমান্ড আনোয়ারসহ ১২ জলদস্যুকে আটকের পর র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ জানান, বঙ্গোপসাগরে বেশ কয়েকটি মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতি এবং বাঁশখালী-কুতুবদিয়া চ্যানেলে জলদস্যুতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে তদন্ত শুরু করি আমরা। এরই প্রেক্ষিতে ৪৮ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতি করার সময় জলদস্যু গ্রুপ আনছার বাহিনীর ১২ সদস্ কে আটক করি। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র, তিন হাজার পিস ডাকাতিককৃত ইলিশ মাছ, বিপুল পরিমাণ মাছ ধরার জাল ও ডাকাতের কাজে ব্যবহৃত নৌকা জব্দ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা এসব তালিকাভুক্ত জলদস্যুর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযানে যাব। সাগরে জেলেদের নিরাপদ সাগর উপহার দিতে আমরা সব সময় চেষ্টা করছি। এক প্রকার জলদস্যুদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি।

আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও

সর্বশেষ