২৯ অক্টোবর ২০২৫

ছাত্রলীগের পদ যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’, ইয়াবা ব্যবসা থেকে চাঁদাবাজি—করেন সবই

রবিউল রবি »

ওয়ার্ড ছাত্রলীগের পদধারী নেতা তিনি। তাই করেন না কারও পরোয়া। ছিনতাই-চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা— সবকিছুতেই সমানতালে মাথা খাটান তিনি। তার কাছে যেন নগর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা ‘দুধ-ভাত’। পাত্তা দেন না কাউকেই। বিস্তর অভিযোগ থাকার পরেও তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার সাহস পায়না খোদ তার সিনিয়ররাও। বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রভাব খাটিয়ে হাসিল করেন নিজের অবৈধ স্বার্থ।

তার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ ওবায়দুল হক প্রকাশ ওবায়েদ। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। একই এলাকার এসএম আজিজুল হকের পুত্র তিনি।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু এবং তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি ১৮ নম্বর বাকলিয়া ওয়ার্ডের কমিটির অনুমোদন দেন। সেখানে ওমর ফারুককে সভাপতি এবং এনামুল হক মানিককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ওই কমিটিতেই যুগ্ম সম্পাদক পদে স্থান পায় ওবায়েদ। ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পরপরই সক্রিয় হয়ে উঠেন ইয়াবার কারবারে।

২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট এস.এম ওবায়দুল হক এবং তার ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ আহম্মদ হোসেন রুবেল প্রকাশ ডন রুবেল গিয়েছিলেন বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করতে। সেখানে সেই ইয়াবা কিনতে আসেন মাইন উদ্দিন হাসান জয় নামে এক ক্রেতা। কেনার পরে চলে যায় রুবেল ও ওবায়দুল। এরপর সেই ক্রেতা পুলিশ দেখে দৌড়ে পালানোর সময় আটক হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সেই ইয়াবা সে ওবায়দুল হক এবং তার ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ আহম্মদ হোসেন রুবেলের কাছ থেকে কিনেছে।

এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই বাকলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাসুদুর রহমান খান বাদী হয়ে মইন উদ্দিন খান জয়কে ১ নম্বর আসামি করে ডন রুবেল এবং ওবায়েদের নামে মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওবায়েদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৫ জুন করা একটি মাদক মামলা রয়েছে। এছাড়া, তার ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ ডন রুবেলের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে আরও দুইটি।

কব্জির জোরে ছিনতাই

২০১৫ সালের ২ মার্চ। বাকলিয়ার সৈয়দ শাহ রোডের হাসনাহেনা স্কুলের সামনে কমরু উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীর মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে তাকে নামায় ছাত্রলীগ নেতা ওবায়েদসহ আরও ৩ ব্যক্তি। এরপর তার জ্যাকেটের পকেটে থাকা ৪৬ হাজার টাকাসহ তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় তারা।

এ ঘটনার পর তার পরদিন বাকলিয়া থানায় ছাত্রলীগ নেতা ওবায়েদকে অভিযুক্ত করে একটি অভিযোগ দায়ের করেন ওই ব্যাবসায়ী।

কু-ককর্মের সাফাই গাইছে ওয়ার্ড ছাত্রলীগ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতা ওবায়েদের এসব কু-কর্মের পরেও তাকে মাথায় তুলে রাখছে খোদ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মানিক। যত অপকর্মের অভিযোগই ওবায়েদের বিরুদ্ধে আসে—মানিক তাকে ‘দুধে ধোয়া তুলশি পাতা’ বানাতে সবসময় উঠে পড়ে লাগে।

ওই ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে ইচ্ছুক একাধিক ছাত্রনেতা জানান, ওবায়েদের ইয়াবা ব্যবসা, ছিনতাই-চাঁদাবাজির টাকার একাংশ ঢোকে মানিকের পকেটেও। এর জন্যেই ওবায়েদকে শেল্টার দেন তিনি।

এদিকে নিজ কমিটির অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতার ইয়াবা ব্যাবসার ব্যাপারে অবগত নয় বলে জানান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মানিক।

তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি কিংবা ইয়াবা ব্যবসা করে এমনটা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। মামলা বা অভিযোগ হতেই পারে। এটাতো প্রমাণিত নয় সে অপরাধ করেছে।’

২০১৯ সালে এক বছরের মেয়াদের কমিটি এখনও কিভাবে চলে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নগরের নেতারা বুঝবে সেটা। আর শুধু আমার ওয়ার্ডে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি? ১০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কমিটিরও তো মেয়াদ নেই। সেটা নিয়ে করেন।’

অপকর্ম ভাইরাল হওয়ায় প্রতিবাদ লিপি

সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতা ওবায়েদের ইয়াবা ব্যবসা, চাঁদাবাজি আর ছিনতাইয়ের কু-কর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। অনেকেই তাকে বহিষ্কারের দাবিতে ফেসবুকে পোস্ট করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব পোস্টকে কেবল ‘অপপ্রচার’ হিসেবেই দেখেছেন ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওবায়েদের অপকর্ম ভাইরাল হওয়ায় গত ১২ সেপ্টেম্বর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুক এবং সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মানিক সাক্ষরিত ছাত্রলীগের অফিসিয়াল প্যাডে প্রতিবাদ লিপি লিখে প্রতিবাদও জানান তারা।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুলের মুঠোফোন নম্বরে (০১৮১১-৮৯৫৭৮৭) একাধিক বার চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়নি।

ব্যবস্থা নেবে নগর ছাত্রলীগ

এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘অভিযুক্ত ওবায়েদসহ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের কমিটির ব্যাপারে নগর ছাত্রলীগের কাছে অনেকের অভিযোগ এসেছে। এ ব্যাপারে আমি অবগত। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

মেয়াদোত্তীর্ণ ওয়ার্ড কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে নতুন কমিটি প্রয়োজনবোধ করছি। কারণ সেখানে চলমান কমিটির সভাপতি কিছুদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে বিয়ে করেছেন। যেহেতু ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিবাহিত কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না সেক্ষেত্রে সভাপতি অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে সেখানে একটা নতুন কমিটির খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, নতুন কমিটির ব্যাপারে আমরা ভাবছি।’

আরও পড়ুন