সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার »
কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টের প্রবেশ মুখেই বিশাল সাম্পান আকৃতির মঞ্চ। তার সামনে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিপুল পরিমাণ খালি চেয়ার। সেখানে খেলা করছিল কিছু পথশিশু। সড়কের দুপাশের ফুটপাতের উপর নির্মিত ১৭৫টি স্টলের অধিকাংশই খালি। মঞ্চ পেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই সমুদ্র বালিয়োড়িতে দুপাশে রয়েছে আরো ২৫ টি স্টল। এখানকার কিছু স্টল খালি থাকলেও অধিকাংশ স্টলে শোভা পাচ্ছে গার্মেন্টেসের তৈরি দেশীয় পোশাক।
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্টে ৭দিন ব্যাপি চলমান কোটি টাকার পর্যটন মেলাতে গিয়ে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।
বালিয়াড়ির তীরে জিও ব্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লার পর্যটক ফেরদৌস হিরু ও শাহীন দম্পত্তি বলেন, পুরো সমুদ্র সৈকতের বিচ্ছিরি অবস্থা। কিটকট চেয়ার, ভ্রাম্যমাণ খাবার, ঝিনুকের দোকান ও বিচ বাইকের দখলে বালিয়াড়ি আর নোনা জল দখল করে রেখেছে জেটস্কি ও স্পিডবোট। পাড় ভাঙা সৈকতে বসে কিংবা দাঁড়িয়েও সমুদ্র দেখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মেলা চলছে শুনে এসেছিলাম ঘুরে দেখতে। কিন্তু এখানে দেখি আরও ভয়ানক অবস্থা। সব খালি, দুই একটা খাবারের দোকান আর কিছু গার্মেন্টসের কাপড় ছাড়া কিছুই দেখলাম না। বুঝতে পারছি না এটি কি মেলা না তামাশা!
হোটেল সীগার্ল পয়েন্টে দেখা মেলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের তানিন রায়হান ও শাহাদাত দম্পত্তির।
পর্যটন মেলার ঘোষণা শুনে বেড়াতে এসেছেন কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, কোথায় মেলা হচ্ছে আমরা তা জানি না। কই, কোন গণমাধ্যমেও এর খবর চোখে পড়েনি! আর কিসের ছাড়ের কথা বলছেন? হোটেল কক্ষ কিংবা খাবার কোথাও তো ছাড় পাইনি আমরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমন্বয়হীনতা, আয়-ব্যয়ে নয়ছয় এবং নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থপনায় বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে সাত দিনব্যাপী পর্যটন মেলা। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় লাবণী পয়েন্ট থেকে এক শোভাযাত্রার মধ্য দিয়েই পর্যটন উৎসবের পথচলা শুরু। এতে অংশ নিয়েছে জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, ট্যুর অপােরেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টুয়াক), ও হোটেল-মোটেলর মালিকসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ। র্যালী শেষে লাবণী পয়েন্টে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের প্রবেশ মুখের সামনে এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের মাঝপথেই পর্যটন উৎসব বয়কট করে চলে আসেন কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কায়সারুল হক জুয়েল। তখনও দর্শক আসনের বেশির ভাগ চেয়ার খালি ছিল। নানা অনিয়ম ও অবব্যস্থাপনা দেখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সংবাদকর্মীরা অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে চলে যান।
এব্যাপারে কক্সবাজারের স্থানীয় এক সংবাদকর্মী বলেন, পর্যটন দিবসের উদ্বোধনী ছিল নানা অব্যবস্থপনায় ভরপুর। গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য নির্ধারিত কোন আসন ছিল না। অ্যাপায়নের নামে করেছেন অপমান। এছাড়া সামনের চেয়ারগুলো ছাড়া বাকি আসনগুলো ফাঁকা ও এলোমেলো।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েল বলেন, মেলাটির আয়োজক জেলা প্রশাসন ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। আমি সেই কমিটির সদস্য। কিন্তু মেলা শুরুর আগে এনিয়ে ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাথে কোন সমন্বয় করেনি জেলা প্রশাসন। শুধু মেলা নয় কোন বিষয়েই ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে আগে থেকেই কিছুই জানানো হয়নি। জেলা প্রশাসনের যে বা যারা সমুদ্র সৈকতের দায়িত্বে থাকেন তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স কয়েকদিনে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারা মোটা অংকের বিনিময়ে আমাদেরকে না জানিয়ে রাতের আঁধারে সিদ্ধান্ত নেন। এসব বিষয়ে আমি আগেও তাদেরকে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু তারা শুনেননি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি পদত্যাগ করব।
অনুষ্ঠান বয়কট করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি উপজেলা চেয়ারম্যান। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর মেলার নামে তাদের টাকার নয়ছয় দেখে বিরক্ত ছিলাম। এসব বুঝতে পেরে তারা আমাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেননি। তাই আমি বয়কট করে চলে এসেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির থেকে পদত্যাগ করার। কয়েকদিনের মধ্যেই তারা আমার পদত্যাগ পত্র পাবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কক্সবাজারে সাত দিনের পর্যটন মেলার আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। উৎসব চলবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। মেলা উপলক্ষে লাবণী পয়েন্টের দুপাশের ফুটপাত ও সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে ২০০ স্টল করা হয়েছে। প্রতিদিনই থাকবে নানা আয়োজন।

ঘোষণা মতে উদ্বোধনী দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পাড়া-মহল্লার আঞ্চলিক প্রোগ্রামে গান করা কয়েকজন শিল্পীকে দিয়ে অশুদ্ধ উচ্চারণে গান করিয়েছে। জেলা প্রশাসন, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, হোটেল-মোটেলের কিছু নিম্ন রুচির মানুষ এসব গানে হৈ-হুল্লোড় করলেও অনেকে বিরূপ মন্তব্য পোষণ করেছেন।
জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মইন উদ্দিন বলেন, যাত্রাপালার শিল্পী দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বিশ্ব পর্যটন বিকাশ করতে চান বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রট (এডিএম) মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, বিশ্ব পর্যটন দিবসে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকতকে আরও বেশি আকৃষ্ট করতে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এতে থাকবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আগামী জীবনের প্রজন্ম-বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কৌতুক, বিচ ফুটবল, বিচ ক্রিকেটসহ কক্সবাজারের নানা ঐতিহ্য নিয়ে নাটক।
তিনি আরও বলেন, মেলা চলাকালে তারকা মানের হোটেল কর্তৃপক্ষ ৪০ শতাংশ ছাড় দিবেন এবং অন্যান্য হোটেলগুলো কক্ষ ভাড়া নিবেন ৮০০ টাকা, যেখানে ৪ জন থাকতে পারবেন। পাশাপাশি রেস্তোরাঁগুলোতে দেওয়া হবে ৫০ ভাগ পর্যন্ত ছাড়। একই সঙ্গে সৈকতের কিটকট (বিচ ছাতা), ছবি তোলাসহ পর্যটন-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবাতেও রয়েছে বিভিন্ন ছাড়।
তবে বিশেষ ছাড় নিয়ে কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি নঈমুল হক টুটুল বলেন, ৫০ শতাংশ পর্যন্ত যে ছাড়ের কথা প্রশাসন বলছে, তা নিয়ে মালিকদের সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি।
কক্সবাজারের আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার জানান, আমরা উৎসবে জন্য আর্থিক সহযোগীতা করেছি। এছাড়া আমাদের সমিতির মালিকানাধীন ননএসি রুমগুলো মেলা চলাকালে ৮০০ টাকা ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনও পর্যটকের তেমন সাড়া পাইনি।
এদিকে এত বড় আয়োজন যাদের জন্য সেই পর্যটকের তেমন সাড়া মিলছে না। আগামী এক সপ্তাহে তেমন পর্যটক আসার সম্ভাবনা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে হোটেল-মোটেল অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির মুখপাত্র কলিম উল্লাহ বলেন, এটি পর্যটন মৌসুম নয়। তবুও ১৫/২০ হাজার পর্যটক রয়েছে এখন। এমন পর্যটক সারাবছরই থাকে। উৎসব উপলক্ষে পর্যটক বাড়ার কোন লক্ষণই দেখছেন না বলেও তিনি জানান।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেলা আয়োজনে সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। তবে পর্যটন ব্যবসায়ীদের নানা সংগঠনের আর্থিক সহযোগিতা, ফাইভ স্টার মানের হোটেলের অনুদান, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির নিজস্বস তহবিল, স্টল ভাড়াসহ অন্যান্য কয়েকটি খাত থেকে এই মেলার খরচ বহন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, কমিটি থেকে ৫০ লাখ, বসুন্ধরা গ্রুপের ১০ লাখ এবং স্টল ভাড়া থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা এসেছে। এছাড়া শহরের ৫টি ৫ তারকা হোটেল, ও হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি ও টুয়াক মোটা অংকের অনুদান দিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় দেড়কোটির উপরে মেলা উপলক্ষে ইতিমধ্যে আয় হয়েছে। তবে ব্যয় জানা নেই।
এ বিষয়ে এডিএম আবু সুফিয়ান বলেন,সরকারি কোন বাজেট নেই এই মেলার জন্য। ৫ হাজার গেঞ্জির চাহিদার প্রেক্ষিতে আমরা মাত্র ১২০০ গেঞ্জি এবং ১৫০ পোস্টার পেয়েছি। তবুও আমরা সাহসে ভর করে মেলার আয়োজন করেছি। মেলার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ ১০ লাখ টাকা এবং স্টলগুলো থেকে ভাড়া ১০ হাজার করে নিয়েছি। তবে কিছু স্টলের ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার।
তিনি আরো বলেন, এটি একটি বড় আয়োজন। এমন আয়োজনে ছোটখাট বিচ্যুতি থাকেই। সমস্ত ভুল ও ত্রুটি-বিচ্যুতি আমি আমার কাধে নিচ্ছি। তবুও আসুন সবাই মিলে মেলাটি সুন্দরভাবে সমাপ্ত করি।













