নুরে আলম »
অনেক দিনের ইচ্ছে অবসর পেলে সাজেক যাব। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের লীলাভূমির নাম সাজেক ভ্যালি। বন্ধু-বান্ধব ও দেখে আসা দর্শনীয়দের মুখে শুনে আসছি। সেই থেকেই আমার ইচ্ছে সাজেক যাব। পরিকল্পনা করেই দিন ঠিক করেছি। আমাদের পাঁচ সদস্যের একটি দল, নাম দিয়েছি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। যেহেতু আমরা পদ্মা পাড়ের মানুষ। যাই হোক, আমাদের উদ্দেশ্য সাজেক যাব। আমরা সাজেক ভ্যালির উদ্দেশে প্রথমে, শরীয়তপুর থেকে বিকেল ৫ টায় বিআরটিসি বাসে করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে, ঢাকা সায়েদাবাদ রাত ৮ টার সময় পৌছাই। তাঁর পর, ঢাকা একটি রেস্টুরেন্ট খাবার (মাছ, ডাল, সবজি) খেয়ে নেই।
ঢাকা থেকে আমরা রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে শ্যামলী বাসে করে যাত্রা শুরু করি। বাসেই আমরা পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম কোথায় থাকব কি কি করব কোথায় ঘুরব। মজার মজার গল্প নিয়ে আলোচনা করি।
তবে দুঃখজনক ভাবে বলতে হয়, বাসে ওঠে বসার পর আমাদের সঙ্গী আফজাল হোসেনের হাত থেকে থাফ দিয়ে মোবাইল নিয়ে ছিনতাই কারিরা পালিয়ে যায় ৷ সবার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়৷ আমরা সবাই তাঁকে সান্তনা দিলাম ৷

তার পর কিছু সময়ের জন্য আমরা ঘুমিয়ে যাই। রাত ২ টার সময়ে বাস থামলো একটি রেস্টুরেন্টের সামনে ২০ মিনিটের জন্য। ব্রেক দিল সবাই নাস্তা করে নিল, আমরা সেখান থেকে ভুনা খিচুরি খেয়ে নিলাম। এর পর আমরা বাসে উঠে বসি, বাস বাসের গতিতে চলা শুরু করল আমাদের নিয়ে। বাস আমাদের ভোরবেলা নামিয়ে দেয় খাগড়াছড়ি। সেখানে একটি রেস্টুরেন্ট ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা (ডিম, পরটা বাজি) করে নেই।
খাগড়াছড়ি থেকে আমাদের পাঁচ জনের একটি দলের সাথে, সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্য আসা ১০ জনের একটি দল নিয়ে। আমরা ১৫ জন দু’দিনের জন্য ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া করলাম। সাজেক যাওয়ার জন্য এই গাড়িগুলোই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।
সকাল ১০ টার সময় খাগড়াছড়ি থেকে চাঁন্দের গাড়ি করে, বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য সাজেক ভ্যালির উদ্দেশে রওনা হলাম। খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম থেকে জানতে পারি। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭৩ কি.মি. আর দীঘিনালা থেকে ৪০ কি.মি.। আমরা ১ টার সময় স্বপ্নের সাজেক গিয়ে পৌঁছাই। তার পর আমরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যাই।

সাজেক পৌঁছে একটি রিসোর্টে উঠলাম, রিসোর্টির নাম ছিল নিসর্গ আবাসিক। সেখানে নিজের জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে, রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। সবাই একটু ক্লান্ত ছিলাম, তাই বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে আসে-পাশের দৃশ্যগুলো দেখলাম। তাঁর পর আমরা রাতের দৃশ্য দেখার জন্য বের হয়ে,দোকান থেকে ফানুস কিনে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় বসে ফানুস উড়াই। যা একটি স্মরণীয় মূহুর্ত। তারপর আমরা রাতে ভারবিকিউ পার্টি দেই সাথে তো গান-বাজনা আছেই। আমরা অনেক আনন্দ করে রুমে চলে এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাই। কারণ ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে সূর্যদোয় দেখার জন্য।
ভোরবেলা আমরা মোবাইল এলামের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুম থেকে ওঠি। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। তখনি মনোমুগ্ধকর পৃথিবীর আসল রূপটা দেখলাম। চার পাশজুড়ে সবুজের বুকে ঘন মেঘ এই মেঘের বুক থেকে ভেসে আসছে লাল বর্ণের হাজার বছরের পুরনো সূর্য। এমন দৃশ্য উপভোগ করা যায় সাজেকের সকল স্থান থেকে ৷ মন ভরে সূর্যদোয় দেখলাম যা আমার কল্পনার অতীত। সকালের নাস্তা শেষ করে ১০ টার দিকে আমরা কংলাক ঝর্ণা দেখার জন্য যাত্রা শুরু করি। ঝর্ণা বেশি দূর না কিন্তু পাহাড় থেকে অনেক নিচে নামতে হয় আমাদের, ৩০-৪০ মিনিট এর মত আমরা হেঁটে ঝর্ণাতে পৌঁছাই। ওই খানে অনেক মজা করে গোসল করি ৷ তার পর আমরা রুমের দিকে রওয়ানা দিলাম ৷ পাহাড় থেকে ঝর্ণা অনেক নিচু হওয়ার কারণে, ঝর্ণা থেকে উপরে উঠতে অনেক কষ্ট হয়। এখানে আমরা সবাই লাঠি ব্যবহার করি উপরে উঠার জন্য। এরপর রুমে গিয়ে দুপুরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেই।

এরপর ৪ টার সময় গেলাম সাজেকের সবচেয়ে উঁচু কংলাক পাহাড় দেখতে। একটা মজার বিষয় দেখলাম, পাহাড় অনেক উঁচু হওয়ার কারনে উঠতে যাতে সহজ হয় সেই জন্য স্থানীয় মানুষ ১০ টাকা করে লাঠি প্রতি ভাড়া দেয়। আসার সময় আবার লাঠি ফিরত দিয়ে আসতে হয়। সবার মত আমরাও সেখান থেকে লাঠি নিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। ৪০ মিনিটের মত সময় লাগে পাহাড়ে উঠতে। পাহাড়ে ওঠে অভাক হলাম। এত উঁচু পাহাড়ের মাঝেও মানুষের বসবাস। স্থানীয় লোকদের থেকে জানতে পারি, এখানে ৩ জাতের লোকের বসবাস লুসাই, ত্রিপুরা আর চাকমা— ওইখানে চাকমা উপজাতিরাই বেশি বসবাস করে।
খুব কাছ থেকেই তাঁদের জীবনযাপন পরিবেশ দেখেছি। যাই হোক, কংলাক পাহাড় থেকে মেঘের আসল খেলা দেখা যায়। সেখানে হিমেল বাতাস আর মিষ্টি রোদ। একইসাথে দেখা যায় ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়গুলো। কংলাকে উঠতে পারলে মেঘের স্পর্শ পাওয়া যায়, যা আমি আগে কখনো পাইনি। এখানে আসার পর আমার কাছে সব কিছু প্রথম পাওয়া মনে হচ্ছে। কংলাকে সাজেকের চেয়েও বেশি বাতাস। এক মুহূর্তেই মনটাকে শীতল করে দেয়।
চোখের সামনে দিয়ে মেঘেরা শীতল হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। সাথে তো লুকোচুরি খেলা আছেই। কখনো রদ কখনো বৃষ্টি এই আছে এই নেই, এক পলকে এসে ঢেকে দেয় সব কিছু। ভিজিয়ে দিয়ে হারিয়ে যায়। কংলার সেই স্বর্গরাজ্যে বসবাস করা যায় মেঘের সাথে। প্রিয়ও মানুষটির হাত ধরে ঘূরতে আসে অনেক মানুষ। এরপর আমাদেরকে ড্রাইভার নিয়ে হ্যালি প্যাড়ে যাই। হ্যালি প্যাড় উপভোগ করে সন্ধ্যা নাস্তা করে নেই। তবে সেখান বিভিন্ন ধরনে পাহাড়ি খাবার রয়েছে। তাঁদের হাতের চা খেয়ে রুমে ফিরে আসলাম। এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাই। ভোরবেলা আমরা মোবাইলের এলামের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুম থেকে ওঠি। আবার ভোরের দৃশ্য দেখি।

এবার আমাদের ভাড়া করা গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পালা। দুটি দল আবার একটি দলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে সকালের নাস্তা (ডিম রুটি, বাজি) করে নেই। সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট আছে সাজেক। চেক শেষ করে যথা সময়ে আমরা খাগড়াছড়ি পৌঁছে যাই।
খাগড়াছড়ি একটি ঝর্ণা আছে সেটার নাম রিছাং ঝর্ণা, সেখানেও পাহাড় থেকে অনেক নিচে নামতে হয়। যাই হক আসছি যখন ঝর্নায় গা ভিজিয়ে যাব ঠিক তাই করলাম। তারপর সেখান থেকে চলে গেলাম আলুর টিলা গুহা দেখতে। সেখানে গিয়ে এক চমৎকার দৃশ্য দেখতে পেলাম, সাথে রয়েছে একটি ঝুলন্ত সেতু। যাই হোক, সন্ধ্যা হয়ে গেলো যদিও ড্রাইভার সাহেবের সাথে আমাদের চুক্তি ছিলো সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত কিন্তু সময় হয়ে গেলো ৭:৩০।
তার পর খাগড়াছড়ি থেকে আমরা পাঁচ জন শ্যামলী বাসে করে রাত ১১: ৩০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। কিন্তু চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা যাওয়ার সময় যেহেতু চট্টগ্রামে থাকি, তাই জিইসি নেমে যাই।
লেখক : ছাত্র- পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ













