২৪ অক্টোবর ২০২৫

সাতকানিয়ার আতঙ্ক ‘টাইগার’ ফারুক ধরা, পেছনে কলকাঠি নাড়ে ২ প্রবাসী ভাই

বাংলাধারা প্রতিবেদক »

সাতকানিয়ার ফারুক ওরফে টাইগার ফারুক। নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি—সবদিকেই পারদর্শী তিনি। এলাকার মানুষ তার কাছে যেন জিম্মি। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের শেল্টারেই তিনি করেন এসব অপকর্ম। অবশেষে শীর্ষ এ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

রবিবার (৯ অক্টোবর) দুপুর তাকে উপজেলার পূর্ব গাটিয়া ডেঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

সন্ত্রাসী ফারুক স্থানীয় মিন্টু বাহিনীর অন্ত্রধারী ক্যাডার। নারী নির্যাতন মামলায় গ্রেফতারের পর থেকে মিন্টু বাহিনীর অনুসারীরা তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যাপকভাবে। তবে পুলিশের দাবি—তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অস্ত্র আইনসহ বেশকিছু মামলা আছে। তার অত্যাচারে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ট।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসী ফারুক নলুয়ায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করে না। এলাকায় চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদকসেবন ও বিক্রয়, ভূমি দখল, মারামারি, সন্ত্রাসী হিসেবে ভাড়ায় খাটাসহ সব ধরনের অপরাধের সাথে ফারুক জড়িত।

কে এই টাইগার ফারুক

ফারুক নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়া ডেঙ্গা গ্রামের শামসুল ইসলামের ছেলে। এলাকার ছিঁচকে চোর থেকে এখন বনে গিয়েছে বড় সন্ত্রাসী। নিজের হিংস্রতা প্রকাশের জন্য নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন টাইগার। সেই থেকে ‘টাইগার ফারুক’ নামে পরিচিত এলাকায়।

স্থানীয়রদের ভাষ্যমতে, বাহিনী প্রধান মিন্টুর ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার প্রোফাইলে জুড়ে দেওয়া টাইগারের সাথে মিলিয়ে ফারুকের নামে টাইগার যুক্ত করা হয়েছে। মিন্টু প্রবাস থেকে নিয়মিত টাকা দিয়ে থাকেন ফারুকসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের। ফারুক মিন্টুর নির্দেশে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে এলাকায়।

সূত্র জানায়, ফারুকের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলা রয়েছে সাতকানিয়া থানায়। মামলাগুলো করা হয় অস্ত্র আইনে, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট রাতে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মহিউদ্দিনের বাসায় গুলি করে হত্যা চেষ্টা মামলায় ফারুক কারাগারে যায়। সেখান থেকে মিন্টুর সহযোগীদের নানা তদবির ও চেষ্টায় ফারুককে জামিনে বের করা আনেন। জামিনে এসেই নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে ফারুক। এ ঘটনায় তখন ভিকটিমের নানা হাবিবুর রহমান থানায় এজাহার দাখিল করেন। পরবর্তী ফারুক ফোনে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিলে তা আর বেশি দুর এগোয়নি। মামলা করলে ভিকটিমের মামাকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয় তখন।

পরের স্ত্রীকে তুলে এনে বসবাস

ফারুক চলতি বছরের শুরুর দিকে পার্শ্ববর্তী আমিলাইশ ইউনিয়নের জহির আহম্মদের স্ত্রীকে অস্ত্রের মুখে তুলে এনে বসবাস শুরু করে। অথচ তাদের মধ্যে দেশের প্রচলিত আইন ও ইসলামি শরিয়া মেনে বিয়ে হয়নি। অস্ত্র আইনের মামলায় ফারুক জেলে গেলে তখন ওই মহিলা পালিয়ে চলে যান স্বামী জহির উদ্দিনের কাছে।

কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে ফারুক ওই মহিলার নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণ করে এবং মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মেয়েকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ওই মহিলাকে আবারও জিম্মি করে ফারুক।

যা বলছে ওই নারীর স্বামী জহির আহম্মদ

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের কাছে একাধিকবার আবেদন নিবেদন করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি জোর করে বসবাস করা নারীর স্বামী জহির উদ্দিন। পক্ষান্তরে ফারুকের নানা হুমকি ধমকির শিকার হয়েছেন তিনি। এমনকি বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে সন্ত্রাসী ফারুক একাধিকবার হত্যার হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ জহিরের।

তাই নিরূপায় হয়ে ৬ অক্টোবর আদালতে নালিশী মামলা দায়ের করেন তিনি। আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে লিপিবদ্ধ করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন সাতকানিয়া থানার ওসিকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার (৯ অক্টোবর) ফারুককে গ্রেফতার করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। ১০ অক্টোবর তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন উদ্ধার করা হয় জহিরের স্ত্রী ও সন্তানদের।

জোর করে আরও দুই বিয়ে

এর আগেও ফারুক হিলমিলি এলাকার মনু আকতার নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করে। মনু আকতারের পিতা নুরুল আলম এবং মা আজিমা খাতুন। সেই ঘরে একটি পুত্র সন্তানও আছে। তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়নি। পরবর্তীতে তাকে বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এছাড়া পূর্ব গাটিয়া ডেঙ্গা গ্রামের ইউনুসের মেয়ে আরজু বেগমকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসী ফারুক। কিছুদিন পর তাকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয় বাবার বাড়ি। ওই ঘরেও এক সন্তান রয়েছে। ফারুকের হুমকি ধমকিতে উভয় পরিবার এখন চরম অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতায়। কারণ, গ্রামের মোড়ল মিন্টু বাহিনীর অবস্থান ফারুকের পক্ষে। তারা ফারুককে ব্যবহার করে পুরো এলাকার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। মূলত মিন্টু ও কামাল, কানা মন্জু, মোরশেদ মেম্বারই ফারুককে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তাই আইনের আশ্রয় নিতে সাহস পাচ্ছে না কেউ।

কে এই মিন্টু ও কামাল

পূর্ব গাটিয়া ডেঙ্গা গ্রামের মো. বকসুর ছেলে ফখরুদ্দিন মিন্টু ও কামাল উদ্দিন। তারা দুইজন প্রবাসী। প্রবাস থেকে কিছু দিন পরপর তারা দেশে এসে বিভিন্নভাবে গায়ের জোরে কর্তৃত্ব খাটান। একজনের সাথে আরেকজনের ঝামেলা বাধিয়ে তারা নিজেরা ফায়দা লুটেন। বড় ভাই মোস্তাক আহম্মদের বদান্যতায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তারা বিদেশ যান।

বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোনো মিন্টু কামাল কিছু টাকা উপার্জন করেই পিছু লাগেন বড় ভাইয়ের। তাদের অত্যাচারে বড় ভাই মোস্তাক এখন এলাকা ছাড়া। জমি থেকে ধান পর্যন্ত ঘরে তুলতে দেওয়া হয় না মোস্তাক আহম্মদকে। একইভাবে পুরো এলাকার মানুষ এখন মিন্টু বাহিনীর হাতে জিম্মি। তারাই মূলত পুরো এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্টের কারণ। এলাকার প্রতিটি পরিবারের মধ্যে বিশৃঙ্খলার পেছনে তাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধন রয়েছে—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক মো. আবদুল হান্নান বলেন, ‘এলাকার একটি প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে টাইগার ফারুক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যখন তখন যে কারো সাথে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পটু ফারুক। অল্প টাকায় যেকোনো কাজ করানো যায় তাকে দিয়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগায় ওই প্রভাবশালীরা। এভাবে পুরো এলাকার সাধারণ মানুষকে তারা জিম্মি করে রেখেছে।’

ওসি বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতো আমাদের কাছে। সর্বশেষ নারী নির্যাতন মামলায় সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে হাজতে পাঠানো হয়েছে। স্বামী জহিরের মামলায় ফারুকের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে।’

আরও পড়ুন