রবিউল রবি »
যত্রতত্র জমছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ এবং পানি। রাস্তার পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা রকমের পলিথিনের ব্যাগ। অল্প বৃষ্টিতেই সেখানে জমছে পানি, জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। শুধু সন্ধ্যা কিংবা রাত নয়, দিনের বেলাতেও মানুষ মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ। সরেজমিনে নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে এমন সব চিত্র।
মশা মারতে সিটি করপোরেশন নানা সময়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযানে নামলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। এসব অভিযানকে স্রেফ ‘শো অফ’ বলছেন নগরীর বাসিন্দারা। এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের বাহক। ফলে নগরীতে প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
গত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রামে আরও ৫৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩১ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২৩ জন। এবছর মোট ১১ জন প্রাণ হারিয়েছে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে।
শুধু সন্ধ্যা বা রাতে নয়, দিনের বেলাও মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ মানুষ। মশা থেকে রেহাই পেতে কয়েল বা অ্যারোসল স্প্রে করেও মেলে না মুক্তি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ছেটানো ওষুধেও বন্ধ হচ্ছে না মশার উপদ্রব। তাদের মশা নিধন কার্যক্রমের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে অনেকের— এমন অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শুধু সন্ধ্যা বা রাতে নয়, দিনের বেলায়ও মশার যন্ত্রণায় স্বাভাবিক কাজ করা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ওয়ার্ড থেকে গুটি কয়েক এলাকায় ওষুধ ছিটানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু তাই নয়, কর্পোরেশনের ঔষধেও কমছেনা মশার উপদ্রব৷
চসিক সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মশার ওষুধ কেনায় ব্যয় করেছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। তাছাড়া চলতি অর্থবছরে মশা মারতে আরও ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবুও মশা মারার তেমন কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
এদিকে, ডেঙ্গু বিস্তারের কারণ হিসেবে নগরীর বাসিন্দারা নিজেরাও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, বাসাবাড়িতে থাকা গাছের টব থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে কিংবা আবাসিক এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। এক্ষেত্রে নাগরিকদের সচেতন করতে চসিকের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও কাজে দিচ্ছে না তা।

তবে নগরের বাসিন্দারের দাবি—এডিস মশার প্রজনন রোধে নেই যথাযথ কোনো ব্যবস্থা। রাস্তার পাশের এবং অলি-গলির ভেতরের ময়লা-আবর্জনা সিটি কর্পোরেশন সরিয়ে নিচ্ছে না। ফলে দিন দিন বড় হচ্ছে স্তূপ। এছাড়া নির্মাণাধীন ভবনসহ নানা স্থানে অল্প বৃষ্টিতেই জমছে পানি। যার ফলে, এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও তৈরি হচ্ছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের নিচে ও ভেতরে, ময়লা-আবর্জনা ভর্তি নালায়, রাস্তার পাশে জমে থাকা পানি, ডাবের খোসা ও পলিথিনের ব্যাগে জমে থাকা পানিতে জন্ম নিচ্ছে এডিসের লার্ভা। কারণ, এসব জায়গা এডিস মশার প্রজননের ক্ষেত্রে অনুকূল স্থান।
এদিকে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রামে পরিদর্শনে আসা ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা নগরের ১০ জায়গাকে ডেঙ্গুর অন্যতম ‘হটস্পট’ বলছেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই আগ্রাবাদ, হালিশহর, সিডিএ, ডবলমুরিং, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, পাহাড়তলী, দেওয়ানহাট, বড়পোলসহ আরও কয়েকটি এলাকার বাসিন্দা।
আগ্রাবাদ মুহুরিপাড়ার বাসিন্দা মো. জালাল বাংলাধারাকে বলেন, ‘গত একমাস ধরে মশার উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নানা সময়ে ওষুধ ছেটানোর কথা শুনলেও আমার এলাকায় সম্প্রতি এমন কোন কার্যক্রম দেখিনি। ফলে এলাকায় দিন দিন মশার উৎপাত বাড়ছেই। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও।’
হালিশহরের কলেজছাত্র আলভিন ইভান বলেন, ‘সন্ধ্যার পর পড়তে বসলেই মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাই। কয়েল জ্বালিয়েও শান্তি পাইনা। বাধ্য হয়ে মশারি টাঙিয়ে পড়তে হয়। এটা তো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয় বা স্থায়ী সমাধানও নয়। আমরা চাই স্থায়ী সমাধান।’
আমি গত একমাসে আমার এলাকায় সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট কাউকে মশার ওষুধ ছেটাতে দেখিনি। অথচ, পেপার-পত্রিকায় প্রায়ই দেখি মশা মারতে সিটি কর্পোরেশনের ওষুধ ছেটানোর নামে লোক দেখানো তোড়জোর।
জসিম উদ্দিন, স্থানীয় বাসিন্দা
ইপিজেড এলাকার আকমল আলী রোডের স্থানীয় বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি গত একমাসে আমার এলাকায় সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্ট কাউকে মশার ওষুধ ছেটাতে দেখিনি। অথচ, পেপার-পত্রিকায় প্রায়ই দেখি মশা মারতে সিটি কর্পোরেশনের ওষুধ ছেটানোর নামে লোক দেখানো তোড়জোর। করোনার প্রাদুর্ভাব কমার পর এখন ডেঙ্গু রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হলেই মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাই। বাচ্চারা পড়াশোনায়ও মনোযোগ দিতে পারছেনা। তাই আমি কাউন্সিলর মহোদয়কে অনুরোধ করব যেন পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে আমাদের এলাকার দিকে একটু নজর দেন।’

পতেঙ্গার বাসিন্দা ইয়াকুব আলী বলেন, ‘করোনার চেয়েও এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই নগরীতে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তায় দেখা যায় ময়লা আবর্জনার স্তূপ। এগুলো পরিষ্কার করার দায়িত্ব কাদের? পানি জমে বিভিন্ন অলিতে-গলিতে এডিসের লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছেটাতে দেখি। কিন্তু ধোয়াই শুধু ওড়ে, এই যন্ত্রণার নিষ্পত্তি তো হচ্ছেনা।’
আমার এলাকায় বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও ৩৮০টি গার্মেন্টস রয়েছে। সবগুলি প্রতিষ্ঠানের ময়লা এনে স্টিলমিল বাজারের এক জায়গায় ফেলে। যা পরিষ্কারে আমাকে যথেষ্ট বেগ পোহাতে হয়। আমি নিজে দাঁড়িয়ে এই ময়লাগুলো প্রতিদিন অপসারণের চেষ্টা করি।
আবদুল বারেক, ৪০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর
শুধু কর্পোরেশনের দেয়া ওষুধই নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মশার ওষুধ ছেটাচ্ছেন জানিয়ে ৪০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল বারেক কোম্পানি বলেন, ‘পূজার কারণে ওষুধ ছেটানো কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও এখন প্রতিটি মসজিদে শুক্রবার এবং বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবার ওষুধ ছেটানোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমারও একটি ফগার মেশিন রয়েছে। সেটি দিয়ে আমি নিজেও মশার ওধুধ স্প্রে করি। আমার এলাকায় বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও ৩৮০টি গার্মেন্টস রয়েছে। সবগুলি প্রতিষ্ঠানের ময়লা এনে স্টিলমিল বাজারের এক জায়গায় ফেলে। যা পরিষ্কারে আমাকে যথেষ্ট বেগ পোহাতে হয়। আমি নিজে দাঁড়িয়ে এই ময়লাগুলো প্রতিদিন অপসারণের চেষ্টা করি।’
এ প্রসঙ্গে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘মশক নিধন কার্যক্রম অব্যহত আছে। প্রতিদিন মশার ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে। ময়লা পরিষ্কারের কাজও চলছে।’
সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন স্থানে ময়লা আবর্জনা ও পানি জমে থাকতে দেখা গেছে এবং স্থায়ীয়দের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলা কারা বলতেছে? আমাকে নামটা বলেন। আর এটা আমাদের খবর দিতে হবেতো। খবর দিলে আমার টিম চলে যাবে ওখানে ওষুধ নিয়ে।’
এ বিষয়ে ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘আমার এলাকায় বিভিন্ন দিকে প্রতিদিন মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। সকালে এবং বিকেলের জন্য ৪ জন লোক ফিক্সড করা আছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মশার ওষুধ ছিটিয়ে আসে। কর্পোরেশন থেকে দেয়া ওষুধ আগামী এক সপ্তাহের জন্য মজুদ আছে।’
ময়লা-আবর্জনার স্তূপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতি ২৪ ঘন্টা পর পর আমরা ময়লা আবর্জনা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। আকমল আলী রোডের খোলা ড্রেন কিছুদিন আগে ৯ লাখ টাকা খরচ করে এক্সকেভেটর ও ড্রাম ট্রাক ব্যবহার করে পরিষ্কার করেছি। প্রতি মাসে তো এভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব না। তাই প্রতি দুই বছরে একবার আমরা পুরোটা পরিষ্কার করি। এমনে ওপরের ময়লাগুলো রুটিন অনুসারে আমরা পরিষ্কার করে ফেলি। ভরাট মাটিগুলো দুই বছর পর পর পরিষ্কার করি।’
২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদের কাউন্সিলর নাজমুল হক (ডিউক) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। সিটি কর্পোরেশন থেকেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।’













